সারাদেশে আট শতাধিক শিক্ষকের জাল সনদ ধরা পড়েছে। তাদের কারও একাডেমিক, কারও কম্পিউটার, কারও লাইব্রেরিয়ান এবং কারও বিএড সার্টিফিকেট জাল বলে শনাক্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ)।
এসব শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাবদ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকা গচ্চা গেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তালিকা পাঠানো হবে। এছাড়া আরও অনেক শিক্ষকের সার্টিফিকেট যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জাল সার্টিফিকেটধারী শিক্ষকদের মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রংপুর- এ পাঁচ বিভাগে শিক্ষক নিবন্ধন সনদ ভুয়া ধরা পড়েছে ৫১১ জনের, কম্পিউটারের সনদ ১৯৩ জনের এবং বিএডধারী ও স্নাতক- স্নাতকোত্তরের জাল সার্টিফিকেট দিয়ে শিক্ষকতা করছেন ৫৬ জন। এসব শিক্ষকের তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এর বাইরে আরও ৮০টি জাল সনদ প্রমাণিত হয়েছে।
ডিআইএ এসব তালিকা তৈরি করে শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। বিভিন্ন জেলায় নিয়োগপ্রাপ্ত জাল সনদধারী শিক্ষকরা নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে চলতি বছর ৩০ জুন পর্যন্ত বেতন-ভাতা বাবদ প্রায় ২০ কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন।
ডিআইএ সূত্রে আরও জানা গেছে, সারাদেশের ৩৬ হাজার এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের অডিট রিপোর্ট করতে গিয়ে শিক্ষকদের সনদ যাচাই করা হয়। গত বছর থেকে শুরু হওয়া এ সনদ যাচাইয়ে পাঁচ বিভাগের জাল সনদ প্রমাণিত হওয়া শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে ডিআইএ। কিন্তু মন্ত্রণালয় ও মাউশির একটি চক্র ব্যবস্থা না নেয়ায় বছরের পর বছর ধরে জাল সনদে চাকরি করছেন তারা।
অভিযোগ উঠেছে, লাইব্রেরিয়ান, বিএড-এমএড, শারীরিক শিক্ষা, কম্পিউটার শিক্ষা, ডিগ্রি পাস, দারুল ইহসান, এশিয়ান ইউনিভার্সিটিসহ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাল সনদে তারা চাকরি করছেন।
এ ব্যাপারে ডিআইএ পরিচালক প্রফেসর আহাম্মেদ সাজ্জাদ রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন করতে গিয়ে জাল সনদে শিক্ষকতা করছেন- এমন অনেক শিক্ষকের সার্টিফিকেট শনাক্ত করা হয়েছে। শিক্ষকতার এ মহান পেশাকে রক্ষা করতে আমরা ২০১৪ সাল থেকে সবার সনদ যাচাইয়ে কাজ শুরু করি। এরই অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ৮৪০ জাল সনদধারীকে চিহ্নিত করতে পেরেছি।’
‘এটা অব্যাহত থাকবে। জাল সনদধারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে তাদের তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে’- যোগ করেন তিনি।
ডিআইএ সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে একাধিকবার জাল সনদধারীদের তালিকা দেয়া হয়। সংসদীয় কমিটিও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেও দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি মন্ত্রণালয়।
জাল সনদের শীর্ষে লাইব্রেরিয়ান
ভুয়া সনদধারীদের শীর্ষে আছেন লাইব্রেরিয়ান পদে চাকরিরতরা। সারাদেশে ১২ হাজারের বেশি লাইব্রেরিয়ান পদ রয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে আট হাজার আছেন যারা সম্প্রতি বন্ধ হওয়া বিতর্কিত দারুল ইহসানের সনদধারী। এছাড়া কিশোরগঞ্জের ঈশাখাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটিসহ কয়েকটি বেসরকারি ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে লাইব্রেরিয়ান সনদ বিক্রির অভিযোগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে মাউশি এমপিও শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১০ সালে দারুল ইহসানের সনদ বিক্রি শুরু হয়। ওই সময় লাইব্রেরিয়ান সনদ কেনার হিড়িক পড়ে। আমরা এমপিও করতে গিয়ে দেখি, প্রায় ৮৫-৯০ শতাংশ লাইব্রেরিয়ান প্রার্থীর সনদ দারুল ইহসানের। বিষয়টি খটকা লাগায় তদন্ত শুরু করি। জাল সনদের বিষয়টি প্রমাণ হওয়ার পর ২০১২ সাল থেকে তাদের এমপিও স্থগিত আছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দারুল ইহসানের সার্টিফিকেটধারীদের এমপিও দেয়া বন্ধ রয়েছে।
টাকায় মিলে কম্পিউটার সনদ
সারাদেশে প্রায় ২৪ হাজার কম্পিউটার শিক্ষক আছেন। তাদের অধিকাংশ জাল সনদে চাকরি করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশে প্রত্যেকটি স্কুলে একজন কম্পিউটার শিক্ষক আবশ্যক ঘোষণা করার পরও সারাদেশে সাড়ে ৭শ’ প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে এ শূন্যপদ পূরণ হয়ে যাবে।
কম্পিউটার শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালায় স্পষ্ট বলা আছে, সরকার অনুমোদিত চারটি প্রতিষ্ঠান জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমি (নেকটার), জাতীয় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ও গবেষণা একাডেমি (নেকটার বগুড়া), ডিপ্লোমা ইন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি মেহেরপুর, যুব উন্নয়ন অধিদফতর (মশরপুর নওগাঁ)- এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সার্টিফিকেটধারীদের এমপিওভুক্ত করা যাবে।
ডিআইএ’র কর্মকর্তারা বলছেন, মাঠপর্যায়ে পরিদর্শনের সময় সরকারি অনুমোদন নয় এমন প্রতিষ্ঠান থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে চাকরি করছেন বেশিরভাগ শিক্ষক। গত মাস পর্যন্ত শুধু কম্পিউটার শিক্ষকের জাল সনদ ধরা পড়েছে সাড়ে ৫শ’। এটি চলমান প্রক্রিয়া।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নামমাত্র ছয় মাসের একটি কোর্স করে এমপিওভুক্ত হচ্ছেন এসব শিক্ষক। নিয়োগের পর তারা কম্পিউটার চালু করতে পারেন না- এমন অভিযোগ পেয়েছেন ডিআইএ কর্মকর্তারা।
বিএড ডিগ্রি নিয়েও মহা কেলেঙ্কারি
সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ১৫০টি প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড) ডিগ্রি দেয়া হয়। এমপিভুক্ত হওয়ার পর এ ডিগ্রি দিলে একটি গ্রেড অর্থাৎ ১১ থেকে ১০ গ্রেডে যান শিক্ষকরা। এ বিএড ডিগ্রি নিয়ে মহা কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে। গত দেড় বছরে সরকারি অনুমোদন নেই এবং দারুল ইহসানের মতো বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান থেকে বিএড ডিগ্রি নিয়েছেন ১১ হাজার শিক্ষক। ডিআইএ বলছে, বিএডধারীদের সনদ জাল প্রমাণিত হলে এমপিও বন্ধ না করে গ্রেড এক ধাপ কমিয়ে দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
একাডেমিক সনদও জাল
শুধু কম্পিউটার, বিএড, লাইব্রেরিয়ান সার্টিফিকেট নয়, অনেক শিক্ষকের একাডেমিক সনদও জাল বলে চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে অনেকের ডিগ্রি, অনার্স ও মাস্টার্স সার্টিফিকেট রয়েছে। ভুয়া সনদধারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি তাদের তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক মান্নান বলেন, বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির আবেদন, টাইমস্কেল ও জ্যেষ্ঠতার আবেদনের সঙ্গে দেয়া বিভিন্ন সনদ জাল বলে ধারণা করা হয়। আমরা সেসব যাচাই-বাছাই করতে ডিআইএকে দিয়ে থাকি। সেসবের মধ্যে অধিকাংশই জাল সার্টিফিকেট বলে চিহ্নিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘জাল সনদধারীদের ব্যাপারে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। প্রমাণ পেলে তাৎক্ষণিক তার এমপিও স্থগিত করছি। চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হলে চাকরি থেকে অব্যাহতিরও নজির রয়েছে। এখন পর্যন্ত অনেক শিক্ষকের সার্টিফিকেট জাল বলে চিহ্নিত হয়েছে। তাদের অনেকের এমপিও বাতিল হয়েছে। অনেকের গ্রেড কমিয়ে নিচের গ্রেডে নামানে হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হয়। এ কারণে কারও জাল সনদ শনাক্ত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা স্ব স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠাই। তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা আমাদের কাছে লিখিতভাবে পাঠাতে নির্দেশ দেয়া হয়। অপরাধীদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কমিটির পক্ষ থেকে তা আমাদের কাছে লিখিতভাবে জানানো হয়।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক স্তরে প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষক জাল সনদে শিক্ষকতা করছেন। তারা সরকারের ‘মান্থলি পে-অর্ডার’ বা এমপিও পেয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা বেতন-ভাতা তুলে নিচ্ছেন। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে শিক্ষকদের তিন শতাধিক সনদ তদন্তকালে জাল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ভুয়া সনদধারী শিক্ষকের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে- এমন উদ্বেগ প্রকাশ করে তাদের কাছ থেকে টাকা ফেরত নেয়ার সুপারিশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ডিআইএ।
ডিআইএর নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৮১ সাল থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত সারাদেশে ৫১ হাজার ৯৯২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে প্রায় পৌনে চার লাখ শিক্ষকের সনদ জাল বলে চিহ্নিত করেছে ডিআইএ। এসব শিক্ষক এ সময়ে সরকারি কোষাগার থেকে ৪৮২ কোটি ৭৮ লাখ ৫১ হাজার ৫৫৭ টাকা বেতন-ভাতা হিসাবে উত্তোলন করেছেন।
ডিআইএর পরিচালক আহাম্মেদ সাজ্জাদ রশীদ এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, ‘জনবল সংকট ও সামর্থ্যের কারণে সব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে সরেজমিন তদন্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই শিক্ষক নিয়োগ ও এমপিওভুক্তির আগে তাদের সব সনদ সঠিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।’
‘আমার ধারণা, তদন্তের বাইরে থাকা জাল সনদধারী শিক্ষকের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। এ সংখ্যা ৬০ হাজারেরও অধিক হতে পারে’- যোগ করেন তিনি।
খবর কৃতজ্ঞতাঃ ডেইলি সানশাইন