জলরাশির অপার সৌন্দর্য হারিয়ে পদ্মা এখন ধু-ধু মরুভূমি। শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই শুকিয়ে এমন পরিণতি হয়েছে এক সময়ের খরস্রোতা এই নদীটি। তাই বেড়েছে চরের বিস্তৃতি। যতদূর চোখ যায়, চোখে পড়ে শুধু বালুরাশি। পদ্মার প্রবেশদ্বার রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় এমন অবস্থা বিরাজ করছে।
পদ্মার এই করুণ পরিণতিতে অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে বরেন্দ্র অঞ্চলের খাল-বিল, নদী-নালা। একই সঙ্গে দ্রুত নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। পদ্মা পানিশূন্য হওয়ার পাশাপাশি ভূগর্ভের পানির স্তরও নামছে নিচে। ঠিকমতো পানি মিলছে না গভীর নলকূপে। দেখা দিয়েছে সেচ ও পানীয় জলের সংকট। এ অবস্থায় পদ্মা নদী ড্রেজিং করে পদ্মায় পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্রোত না থাকায় প্রতি বছর লাখ লাখ টন পলি এসে জমছে পদ্মার বুকে। বাড়ছে বালুচরের বিস্তৃতি আর ঘনত্ব। গত পয়তাল্লিশ বছরে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে বালুচরের উচ্চতা বেড়েছে আঠারো মিটার। বর্ষা মওসুমে মাস তিনেকের জন্য নদীতে পানি থাকলেও বছরের নয় মাসজুড়েই তলানিতে থাকছে পানি। ফলে পদ্মা মরে যাবার সাথে সাথে এর শাখা-প্রশাখা নদ-নদীগুলোর অস্তিত্বও প্রায় বিলীন।
শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা নদীর পানির ভাগাভাগির লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে ভারত সরকারের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি পানি চুক্তি করে বাংলাদেশ। চুক্তিতে ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ মে পর্যন্ত সময়কে অবহিত করে প্রতিটি মাসকে তিন চক্রে ভাগ করা হয়েছে। কোন চক্রে কী পরিমাণ পানি পাবে তা চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে। ঠিকমতো পানিবণ্টন হচ্ছে কি-না তা দেখার জন্য যৌথ নদী কমিশনের সদস্যরা প্রতিবছর বাংলাদেশ-ভারত সফর করেন। এবার চুক্তি মোতাবেক শুকনো মৌসুম শুরু হবার পর হঠাৎ করে যৌথ নদী কমিশন শোরগোল তুলে জানান দেয়, পদ্মায় বিগত বছরগুলোর তুলনায় প্রচুর পানি এসেছে। কিন্তু বাস্তবে গিয়ে পদ্মায় সে পানি দেখা যায়নি। পানিহীন পদ্মা নদীতে দেখা গেছে শুধু বালুচর।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, গত কয়েক বছর থেকে পদ্মায় পানির গভীরতা ১৩ থেকে ১৪ মিটারে ওঠানামা করে। তবে ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পদ্মায় সর্বোচ্চ পানির গভীরতা রেকর্ড করা হয় ২৪ দশমিক ১৪ মিটার। পরিবেশবিদরা বলছেন, চুক্তিমতো পানি পাওয়া গেলে পদ্মার এমন করুণ দশা হতো না। পানি না পাওয়ার কারণে এখন বর্ষার সময় কিছু পানি থাকলেও সারা বছর থাকে শুকনো। নদীতে নৌকা নয়, চলে চাষাবাদ।
এ অবস্থায় বর্তমানে বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গড়ে ১১০ ফুট নিচে অবস্থান করছে। দিন দিন তা আরও নিচের দিকেই যাচ্ছে। তাই এ অঞ্চলের হাজার হাজার গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। ভূগর্ভের পানি নিচে চলে যাওয়ায় পানি সংকট দেখা দিচ্ছে কৃষিকাজেও। চাষাবাদে বাড়ছে খরচ।
পদ্মায় পানি না থাকায় মরে গেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদী। মহানন্দার বুকে ফসলের আবাদ হচ্ছে। আর পাগলা নদীর আগের পাগলামীও নেই। পদ্মা আর মহানন্দার মিলন স্থল গোদাগাড়ীর সারেংপুরের কাছে ঘোলাপানি আর স্বচ্ছ পানির মায়াবি দৃশ্য আর নেই। পাড়ে বসে ছিলেন সত্তর ছুঁই ছুঁই তরিকুল ইসলাম। নদীর পানি কোথায় জানতে চাইলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, নদীতো সেই কবে মরে গেছে। এখন আছে নিষ্প্রাণ বালির উত্তাপ।
গোদাগাড়ীর রেলবাজার ঘাটে আগে বড় বড় জাহাজ ভিড়ত। এখানে পদ্মার প্রবাহ সরে গেছে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। পথে বালুচরেই দেখা মিলল অনেকের যারা চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়ন থেকে সদরে যাচ্ছেন। তারা জানালেন, নদীর পানি শুকিয়ে গতিপথ চলে গেছে অনেক দূরে। সামান্য কিছু অংশ নৌকায় পার হওয়ার পর তাদের বালুচরে হাঁটতে হয়। নৌকার আধাঘণ্টার পথ এখন তাদের হয়ে দাঁড়িয়েছে দুই ঘণ্টা।
নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ভারত আর্ন্তজাতিক নিয়মের তোয়াক্কা না করে উৎস্য ও উজানে গঙ্গার উপর অসংখ্য প্রকল্প নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। যার ফলে ফারাক্কা পয়েন্টে যথেষ্ট পানি পৌঁছাতে পারছে না। এসব প্রাণঘাতি প্রকল্প অপসারণ করা ছাড়া গঙ্গা-পদ্মায় স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার অন্য কোন বিকল্প নেই। রাজশাহীর নদী বাঁচাও আন্দোলনের আহবায়ক এনামুল হক বলেন, ভারত আর্ন্তজাতিক আইন রীতিনীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করে গঙ্গাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানি একতরফাভাবে সরিয়ে নিচ্ছে। এতে নদীতে পানি প্রবাহ কমে গিয়ে গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, পানির প্রবাহ ঠিক থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। পানির প্রবাহ ঠিক না থাকলে নদীর দুই পাশে ভাঙন চলতে থাকবে। আর আমরা প্রতিনিয়ত দুরাবস্থার সম্মুখীন হবো। এজন্য পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে। আর এই হিসাবটাও করতে হবে পুরো গঙ্গা রিভার বেসিন অনুযায়ী। শুধু ফারাক্কা থেকে কত কিউসেক পানি আসছে, তার উপর বিষয়টা নির্ভর করে না।
চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, ভারতের সঙ্গে যে গঙ্গা চুক্তি হয়েছে ফারাক্কায় কত কিউসেক পানি আছে তার উপর হিসাব করে। অথচ ফারাক্কায় পানি আসার আগেই উজানের বিভিন্ন জায়গায় ড্যাম করে পানি আটকে ফেলা হয়েছে। ফলে ফারাক্কায় পানির প্রবাহটাই কম আসে। সেখান থেকে হিসাব করে তো একটা নদীর প্রবাহ ঠিক রাখা যাবে না। এজন্য পানির প্রবাহটা বাড়াতে হবে। প্রবাহ বাড়লে পদ্মা-মহানন্দায় পানি থাকবে। তখন অন্তত এসব নদীর শাখা-প্রশাখাগুলোতেও কিছুটা হলেও পানি থাকবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে। আবার পদ্মায় পানির প্রবাহ ঠিকমত না থাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর চাপও পড়ছে। ফলে পানির লেভেল নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। এর ফলে ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে যদি ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণতা বাড়তেই থাকে, তাহলে একসময় মরুকরণের দিক ধাবিত হতে পারে এই অঞ্চল। তাই এখনই পদ্মার পানির প্রবাহ নিশ্চিতের কোনো বিকল্প নেই।
খবর কৃতজ্ঞতাঃ Daily Sunshine