সরবরাহ কমে যাওয়ায় রাজশাহীর বাজারে হঠাৎ করেই বেড়েছে সব ধরনের আমের দাম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমের মৌসুম প্রায় শেষের দিকে। এরইমধ্যে বাজার থেকে জাত আম খ্যাত গোপালভোগ, লক্ষ্মণভোগ বিদায় নিয়েছে। আর হাতেগোনা কয়েকটি বাগানেই রয়েছে আরেক জাত আম ক্ষিরসাপাত (হিমসাগর)।
বৃহস্পতিবার (২২ জুন) রাজশাহীর বাজারে প্রতি মণ ক্ষিরসাপাত আম বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ২০০ টাকায়। অথচ গত সপ্তাহেই এই আম ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। সরবরাহ কমতে শুরু করায় বেড়েছে রাজশাহীর এই সুস্বাদু আমের দামও।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ সপ্তাহের আর মাত্র ২-৩ দিনেই রাজশাহীর বাজারে ক্ষিরসাপাত আম পাওয়া যাবে। তারপর থেকে উঠবে অন্য জাতের আম। বলতে গেলে বর্তমানে ল্যাংড়া আমই একক রাজত্ব করছে রাজশাহীর আম বাজারে।
তবে সেই আমও ফুরোতে যাচ্ছে আগামী সপ্তাহেই। এর পরপরই বাজারে পাওয়া যাবে সুরমা ও মহারাজসহ বিভিন্ন নামের সুস্বাদু ফজলি, আম্রপালি ও তোতাপুরিসহ নতুন নানা জাতের আম। সর্বশেষ জুলাই মাসের শেষ দিকে বাজারে উঠবে আশ্বিনা জাতের আম। তবে আঁশ ও টক স্বাদের কারণে এই আম কেনার আগ্রহ বরাবরই ক্রেতাদের থাকে না। সাধারণত বিভিন্ন কোম্পানি জুস তৈরি করার জন্য বাগান থেকে এই আম কিনে থাকেন।
তাই শেষ মুহূর্তে অনেকটা বাধ্য হয়েই ক্রেতারা নিজের, পরিবারের ও ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে থাকা স্বজনদের জন্য বাড়তি দাম দিয়ে কিনছেন ক্ষিরসাপাত আম। আর দাম বেশি থাকলেও মৌসুমের শেষ দিকে রাজশাহীর আমের বাজার জমজমাট হয়ে উঠেছে। দিন-রাত সমানতালে আড়ৎ ও খুচরা দোকানগুলোতে আম বিক্রির কাজ চলছে। ব্যস্ত সময় পার করছে খ্যাত এবং অখ্যাত কুরিয়ার সার্ভিসগুলো। রাজশাহী থেকে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট ও বরিশালসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আম পাঠাতে কুরিয়ার সার্ভিসগুলো নিয়েছে বাড়তি পরিবহনের ব্যবস্থা।
রাজশাহীর শালবাগান বাজার মহানগরীর একটি অন্যতম আমের আড়তের এলাকা। বাজারের সামনেই গড়ে উঠেছে অর্ধ শতাধিক আমের আড়ৎ।
সেখানকার আম ব্যবসায়ী মনিরুজ্জামান মিনার বাংলানিউজকে বলেন বর্তমানে ক্ষিরসাপাত আম নেই বললেই চলে। আশপাশের দুই একটি বাগানে ক্ষিরসাপাত আম থাকলেও দাম বেশি।
এই বেশি দাম পাওয়ার আশাতেই এবার আম চাষি ও ব্যবসায়ীরা জেলা প্রশাসন নির্ধারিত সময়েরও অনেক পরে পরিপক্ক করে আম গাছ থেকে ভাঙছেন। কিন্তু ফলন কম হওয়ায় শেষ দিকে সরবরাহ কমে যাচ্ছে। তাই এখন কয়েক জায়গায় ক্ষিরসাপাত পাওয়া গেলেও গত সপ্তাহের তুলনায় মণ প্রতি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা বেশি।
মনিরুজ্জামান মিনার জানান, গত সপ্তাহেও শালবাগানের বিভিন্ন আড়তে সুস্বাদু আম ক্ষিরসাপাত ২ হাজার ৬০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু আজকে সেই খিরসাপাত আম ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ২০০ টাকা দরে মণ দরে বিক্রি হচ্ছে।
এর ওপর মাত্র ১০ দিন আগেই বাজারে ল্যাংড়া আম ওঠে। সেই আমও এখন শেষ পর্যায়ে। গত সপ্তাহেও বাজারে ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু আজ ল্যাংড়া আম ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। মৌসুমের শেষ দিকে সরবরাহ কমে যাওয়ায় আমের দাম হঠাৎ করেই বেড়েছে বলে জানান এই ব্যবসায়ী।
আম ব্যবসায়ী মনিরুজ্জামান মিনার আরও বলেন, জুন মাস প্রায় শেষ। তারপরও আম পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে ক্ষিরসাপাত ও ল্যাংড়া আম পাওয়া যাচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে রমজান মাসে জেলা প্রশাসনের নির্ধারিত সময়ে এবার ব্যবসায়ীরা আম ভাঙেননি। কারণ রমজান মাসে সাধারণত আমের বাজার মন্দা থাকে। এজন্য সবার টার্গেট ছিল ঈদের পরের বাজার ধরার। রমজান ঈদের পর জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই তাই রাজশাহী ও তার আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে এক সঙ্গে আম ভাঙা শুরু হয়। এর পাশাপাশি পুরোদমে কেনাবেচাও জমে ওঠে তাই জুনের প্রথমে।
এখন জুনের শেষ সপ্তাহে এসে আড়ৎ এবং আমের বড় মোকামগুলোতে সরবরাহ কমে গেছে। এর ওপর গত বছরের তুলনায় এবার আমের ফলনও কম হয়েছে। মৌসুমের শুরুর দিক থেকে ঘন কুয়াশা এর পর তীব্র তাপদাহ এবং শিলাবৃষ্টিতে রাজশাহী চাঁপাইনাবগঞ্জ, নাটোর ও নওগাঁসহ আশপাশের জেলায় আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শিলাবৃষ্টিতে আম ঝরে গেছে। যে কারণে এবার আমের ফলন কমেছে বলেও জানান এই ব্যবসায়ী।
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর বাজার জেলার সবচেয়ে বড় আমের মোকাম। সেখানে থাকা আম ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, মৌসুম প্রায় শেষ দিকে। প্রথম দিকে রমজানের কারণে কেনাবেচা হয়েছে কম। কিন্তু ঈদের পর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা ট্রাকে করে আম নিয়ে যাচ্ছেন রাজশাহী থেকে। এছাড়া অধিকাংশ বাগানেই আম প্রায় শেষ দিকে। জাত আম গোপালভোগ, লক্ষণভোগ শেষ। আজকালের মধ্যে শেষ হয়ে যাচ্ছে ল্যাংড়া আমও। এরপর আগামী সপ্তাহের শুরুর দিকে থেকে রাজশাহীর বাজারে ফজলি, আম্রপালি, তোতাপুরি ও বারি-৪ সহ বিভিন্ন জাত, নাম ও স্বাদের আম উঠবে। তবে সরবরাহ কম থাকায় এবার সেসব আমেরও দাম গতবারের চেয়ে বেশি হবে বলে বলে জানান এই ব্যবসায়ী।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. শামসুল হক জানান, চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে প্রায় ২ লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টন আমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলন কমার কারণে শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নাও হতে পারে। তবে এতে সমস্যা হবে না। যে ফলন হবে তা দিয়ে রাজশাহীসহ সারা দেশের আমের চাহিদা পূরণ সম্ভব বলেও মত দেন কৃষি বিভাগের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
রাজশাহীতে সাধারণত সবার আগে পাকে গুটি জাতের আম। এবার জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৫ মে থেকে গুটি আম নামান চাষিরা। আর উন্নতজাতের আমগুলোর মধ্যে গোপালভোগ ২০ মে, রাণীপছন্দ ২৫ মে, ক্ষিরসাপাত বা হিমসাগর ২৮ মে এবং লক্ষ্মণভোগ বা লখনা ২৬ মে থেকে নামানো হয়। এছাড়া ল্যাংড়া ও আম্রপালি আম ৬ জুন থেকে নামাতে পারেন। ১৬ জুন থেকে ফজলিও নামানো যাবে। তবে রাজশাহীর বাগানগুলোয় এখনও ফজলি আম ভাঙা হয়নি। সব শেষ ১৭ জুলাই থেকে নামবে আশ্বিনা জাতের আম।
খবর কৃতজ্ঞতাঃ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর