আমকেন্দ্রিক পর্যটনের অর্থনীতি এখন দারুণ চাঙা। গত রোজার ঈদের পর থেকেই এ খাতে লেনদেন জমজমাট হয়ে উঠেছে। আগামী সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বাজারে আমের সরবরাহ থাকবে।
ফলে ওই সময় পর্যন্ত আমকেন্দ্রিক পর্যটন ও অর্থনীতি চাঙা থাকবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। আমকে কেন্দ্র করে বিশেষ করে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, সাতক্ষীরা অঞ্চলে আমের পর্যটন ও অর্থনীতি বেশ জমে উঠে। এছাড়াও সীমিত আকারে গাজীপুরের শ্রীপুর ও পার্বত্য অঞ্চলেও আমের প্রবাহ রয়েছে।
সারা দেশে শুধু আম কেন্দ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। এর মধ্যে অর্ধেক লেনদেন হচ্ছে গ্রামে। বাকি অর্ধেক শহরে। এর মধ্যে দেড় হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে আমের রাজধানী বলে খ্যাত রাজশাহী অঞ্চলে।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সারা দেশে ২৩টি জেলায় আমের ভালো ফলন হয়। এর মধ্যে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সাতক্ষীরা জেলায় সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদিত হয়। এছাড়া প্রায় সব জেলায় কম বেশি বিভিন্ন জাতের আম উৎপাদন হয়। দেশে গড়ে ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়।
এগুলোতে আম উৎপাদন হয়েছে ৬ লাখ ৬৮ হাজার টন। গ্রাম এলাকায় প্রতি কেজি আম গড়ে ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এ হিসাবে আম বিক্রি বাবদ চাষীরা পাচ্ছে ২ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে প্রতি কেজি আম গড়ে বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা করে। এ হিসাবে খুচরা ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন ৫ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।
এছাড়া প্রতি কেজি আম পরিবহনে রাজশাহী থেকে ঢাকায় আনতে খরচ হচ্ছে ১৫ টাকা। ঢাকার বাইরে নিতে খরচ হচ্ছে ২৫ টাকা। এর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের যাতায়াত, থাকা-খাওয়া, আম বাজারজাত করতে টুকরি তৈরি, বাধা এসব কাজে আরও অর্থের সংযোগ রয়েছে। এসব মিলে আমের অর্থনীতি এখন দারুণ চাঙা।
ফেব্রুয়ারিতে আমের মুকুল আসা শুরু হয়। আর আম বিক্রি শুরু হয় মে থেকে। চলে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এ সময় শুধু রাজশাহী অঞ্চলেই বাগান পরিচর্যা, ঝুড়ি তৈরি, কুরিয়ার, পরিবহনসহ আম বাজারজাতকরণে অন্তত দুই লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। এ সময় আমের বৈচিত্র্য দেখতে রাজশাহী অঞ্চলে অনেক পর্যটকের আগমন ঘটে। ফলে আমের পাশাপাশি হোটেল, মোটেল গণপরিবহন এসব খাত চাঙা হয়ে উঠে। শ্রীপুরের আমের বাগানগুলোতেও পর্যটকদের ভিড় জমে। ইতিমধ্যে গাজীপুরের আম শেষ হয়ে গেছে। এখন চলছে কাঁঠালের অর্থনীতি।
চলতি বছর রাজশাহী অঞ্চলে দেড় হাজার কোটি টাকার আম বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে। এর পাশাপাশি পরিবহন ও কুরিয়ারসহ আনুষঙ্গিক অন্য খাতে ব্যবসা হবে আরও পাঁচশ কোটি টাকার। সব মিলিয়ে মৌসুম শেষে লেনদেন হবে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার। ফলে আমকে কেন্দ্র করে প্রতি মৌসুমের ন্যায় এ বছরও চাঙা হয়ে উঠেছে বৃহত্তর রাজশাহীর অর্থনীতি। এ বছর ১৫ মে থেকে গাছ থেকে গুটি আম পাড়া শুরু হয়।
এর মাধ্যমেই বাজারে আম আসতে শুরু করে। এরপর মে জুড়ে গোপালভোগ, রানীপছন্দ, খিরসাপাত আম বাজারে আসে। ল্যাংড়া আম পাড়ার সময় ছিল ৬ জুন। আর ফজলি পাড়া শুরু হয় ১৬ জুন। সর্বশেষ আশ্বিনা পাড়ার সময় রয়েছে ১৭ জুলাই।
এ অঞ্চলে আমের সবচেয়ে বড় মোকাম রাজশাহীর বানেশ্বর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট হাট। আমের মৌসুমে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দুটি হাটে আম বেচাকেনা চলে।
বানেশ্বর হাটের আম বিক্রেতা নুরুল ইসলাম বলেন, হাটে প্রায় দুই শতাধিক আমের আড়ত রয়েছে। এগুলোতে ১০ হাজার মৌসুমি শ্রমিক কাজ করেন। ঝুড়ি তৈরিতেও এ অঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষ কাজ করেন। এছাড়া রিকশাভ্যান, ভটভটিও চালান কয়েক হাজার মানুষ। সব মিলিয়ে আমের মৌসুমে শুধুমাত্র এ এলাকারই ৭০-৮০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী পৌরসভা সদরের আমচাষী আবদুল মজিদ বলেন, আমকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষের মৌসুমি কর্মসংস্থান হয়েছে। কেউ বাগান পাহারা দিচ্ছেন, কেউ বাগানের পরিচর্যার কাজ করছেন। কেউ ভ্যান-ট্রলি চালিয়ে আম পরিবহনের কাজ করছেন। কেউ আড়ত খুলে বসেছেন, কেউ প্যাকেটিংয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কুরিয়ার সার্ভিসগুলোতে এখন উপচেপড়া ভিড়। প্রতিদিন হাজার হাজার কেজি আম কুরিয়ারে করে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সূত্রে জানা গেছে, এবার রাজশাহী জেলার প্রায় ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় দুই লাখ টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। আর পাশের জেলা জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল প্রায় আড়াই লাখ টন। ঝড়ে ক্ষতি হওয়ার পরও কৃষি বিভাগের দাবি, লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর রাজশাহী বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক দেব দুলাল ঢালী জানান, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ মিলে এ বছর দেড় হাজার কোটি টাকা মূল্যের আম উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। আশা করছি, এ মৌসুমে আমচাষীরা লাভবান হবেন।
খবর কৃতজ্ঞতাঃ যুগান্তর