প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার নিমদীঘি গ্রামের গৃহবধূ সাঈদা রায়হানা। ভালো ফলাফল করেও চাকরির পেছনে ছোটেননি তিনি। পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও নেমে পড়েছেন ব্যবসায়।
স্বল্প পুঁজিতে গ্রামীণ নারীদের হাতের কাজের রকমারি পণ্য নিয়ে শুরু করেছেন স্বপ্নযাত্রা। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম ‘অপরাজিতা’। এটি ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান তিনি। একই সঙ্গে পিছিয়ে পড়া গ্রামীণ নারীদের আর্থিক ভিত গড়ে দিতে চান।
সাঈদা রায়হানা জানান, হাতের কাজের দক্ষতা বাড়াতে তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তার দলের নারীরাও বেশ দক্ষ। তারপরও তিনি বিনিয়োগে ঝুঁকি নিতে সাহস পাচ্ছিলেন না। কিন্তু বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প-ইএসডিপির আওতায় রাজশাহীতে প্রশিক্ষণ নেয়ার পর সেই ভীতি কেটেছে।
সাঈদা হস্তশিল্প নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বাণিজ্যিক ভেড়ার খামার এবং ভেড়ার পশম থেকে বস্ত্র উৎপাদন শিল্প গড়ে তুলতে চান। তবে তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মূলধন।
ইএসডিপির রাজশাহীর আরেক প্রশিক্ষণার্থী শাকিলা বাশার শিমুল। ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এমএস (মাস্টার্স) করেছেন তিনি। ৫ বছর শিক্ষকতাও করেছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তার লক্ষ্য ছিল সরকারি চাকরি। কিন্তু ধরা দেয়নি সোনার হরিণ। শেষে সিদ্ধান্ত নেন আর চাকরির পেছনে ছুটবেন না, উদ্যোক্তা হয়ে নিজেই অন্যদের চাকরি দেবেন। শিমুল কাজ করতে চান রাজশাহীর ঐতিহ্য রেশম শিল্প নিয়ে। কিন্তু তারও মূলধন সংকট।
শাকিলা বাশার শিমুল জানান, বাবা রাজশাহী নগরীর প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। স্বামীও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন ব্যবসায়। তারপরও মূলধন জোগাতে বিদেশ থেকে প্রসাধনী আমদানি এবং অনলাইনে বিক্রি শুরু করেছেন। তারও লক্ষ্য নিজের পরিচয় তৈরি।
রাজশাহী কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তণুশ্রী ঘোষ। তার বান্ধবী কামরুন নাহার মিতু পড়েন এই কলেজে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে। তারা জেলার পবা উপজেলার নওহাটা এলাকার বাসিন্দা। ঘনিষ্ঠ এই দুই বান্ধবী পড়াশোনা শেষ না হতেই স্বপ্ন দেখছেন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার।
এরই মধ্যে তারা প্রসাধনী পণ্য আমদানির পর অনলাইনে বিক্রি শুরু করেছেন। কিন্তু মূলধন সংকটে এগুতে পারেননি বেশি দূর। ইএসডিপির প্রশিক্ষণ নেয়ার পর আত্মবিশ্বাস বেড়েছে তাদেরও।
তারা চান, এলাকায় উৎকৃষ্টমানের বেকারি শিল্প গড়তে। প্রতিষ্ঠা করতে চান বোতাম শিল্প। নিজেদের ভাগ্য বদলে দিতে চান, ভাগ্য গড়ে দিতে চান তাদের মতো আরও অনেকেরই।
প্রায় এক যুগ ধরে আইসিটি খাতে কাজ করছেন মাহবুব আরা নীলা। দীর্ঘদিন ধরেই ভাবছিলেন নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাবেন। মূলধনও জোগাড় করে ফেলেছিলেন। কিন্তু বিনিয়োগের সাহস পাচ্ছিলেন না।
তার ভাষ্য, ইএসডিপির প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি আত্মবিশ্বাস পেয়েছেন। এরপর সময় নষ্ট না করে নেমে পড়েছেন ব্যবসায়। চালু করতে যাচ্ছেন নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘মেট্রয়েল আইটি’।
ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষ করে ঘরেই বসেছিলেন গৃহবধূ সিফাতুন নাহার মীম। রান্নাবান্নায় প্রচণ্ড শখ ছিল তার। সেই শখ থেকে নেমে পড়েছেন শৌখিন রান্নায়। ইএসডিপির প্রশিক্ষণ নেয়ার পর স্বামীর সহায়তায় গড়ে তুলেছেন হোম কিচেন ‘ব্যঞ্জন’। এরই মধ্যে বেশ নামও করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
মীম জানিয়েছেন, রান্নায় আগ্রহ আছে এমন শিক্ষিত ও বেকার শহুরে নারীদের নিয়ে তিনি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে তুলতে চান ‘ব্যঞ্জন’কে। নিজস্ব আউটলেট প্রতিষ্ঠা করতে চান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে রাজশাহীতে শুরু হয়েছে ইএসডিপির প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। এখানে ১৫টি ব্যাচে ২৫ জন করে মোট ৩৭৫ জন প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবেন। এরই মধ্যে ৫টি ব্যাচে এই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ১২৫ জন তরুণ উদ্যোক্তা। পুরুষদের পাশাপাশি এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে সফল উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন বুনছেন নারীরাও।
ইএসডিপির জেলা প্রশিক্ষক জামিলা আফসারী আলম জানান, দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনমুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে বিনিয়োগ প্রসার ঘটানো তাদের মূল লক্ষ্য। এরই অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী ও বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রিসোর্স পারসনদের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ চলছে। ব্যবসায়ী সংগঠন এবং সফল ব্যবসায়ীরা নতুন উদ্যোক্তাদের মেন্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাছাড়া প্রায়োগিক জ্ঞান অর্জন ও বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনে শিল্প প্রতিষ্ঠানও পরিদর্শন করানো হচ্ছে।
সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারির পরিসংখ্যান বলছে, রাজশাহীর অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এর মধ্যে গ্রামীণ নারীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। কৃষি উৎপাদনে সরাসরি জড়িত রাজশাহীর বিপুল সংখ্যক গ্রামীণ নারী। এছাড়াও ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, ব্যবসা, চাকরি এমনকি শিল্প কারখানায় পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করছেন এ অঞ্চলের নারীরা।
শিক্ষা, দক্ষতা ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাড়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এখনও নারীদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় সমস্যা রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ উইমেন্স চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিডব্লিউসিসিআই) রাজশাহী বিভাগের সভাপতি মনিরা মতিন জোনাকী।
তিনি বলেন, রাজশাহীর নারীদের একটি বড় অংশ কুটিরশিল্প নিয়ে কাজ করছেন। একই ধরনের কাজ করছেন অনেকেই। অনেকেই সমবায়ী হিসেবে কাজ করছেন। এতে স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে উৎপাদিত পণ্য। ফলে দেশীয় বাজার নষ্ট হচ্ছে, হারিয়ে ফেলছে রফতানির সুযোগ।
বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উচিত- যে সকল নারী উদ্যোগী তাদের নিয়ে গ্রুপভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা। তাছাড়া বড় বিনিয়োগে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে চাপ প্রয়োগ করতে পারে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এসব সুবিধা পেলে রাজশাহীর নারীরা আরও এগিয়ে যাবে।
বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের রাজশাহীর পরিচালক একেএম বেনজামিন রিয়াজী জানান, রাজশাহী মূলত শিক্ষা নগরী। ফলে এখানে সেইভাবে বাণিজ্য প্রসার লাভ করেনি। আমরা তরুণদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলছি। ফলে এখন দৃশ্যপট পাল্টাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এই অঞ্চল কৃষি প্রধান। ফলে এখন কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠছে। দেশে এই খাত বিকাশ লাভ করলে সেই ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে রাজশাহী।
খবর কৃতজ্ঞতাঃ জাগোনিউজ২৪