লিখেছেন মীর রাসেল আহমেদ, প্রতিষ্ঠাতা, রাজশাহী এক্সপ্রেস
এ মুহূর্তে আমি বসে আছি দুবাইয়ের মিডিয়া সিটির একটি অফিসে। জানালা দিয়ে নীল সাগর আর সমুদ্রের বুকে গড়ে ওঠা গাছ আকৃতির পাম জুমেইরাহ এলাকা দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে গান শুনছিলাম। দেখছিলাম আমাদের উপমহাদেশসহ সারা বিশ্বে এ সপ্তাহে নতুন কোন কোন গান মুক্তি পেতে যাচ্ছে।
সম্প্রতি আমি যোগ দিয়েছি বিশ্বের জনপ্রিয় অডিও কোম্পানি স্পটিফাইতে। এটি মূলত একটি ইন্টারনেটভিত্তিক আন্তর্জাতিক মিউজিক ও পডকাস্ট স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম। যেখানে ব্যবহারকারীরা ফোন, কম্পিউটার, স্মার্টওয়াচ কিংবা অন্যান্য ডিজিটাল যন্ত্র ব্যবহার করে বিনা মূল্যে অডিও গান কিংবা পডকাস্ট উপভোগ করতে পারেন।
২০১০ সালে জীবনে প্রথম ঢাকা দেখা এই আমি ২০২৩-এ দুবাই পৌঁছে যাব, কখনো কি ভেবেছিলাম?
প্রথম আলো ও ইন্টারনেট জিনিয়াস
আমার বেড়ে ওঠা রাজশাহীতে। আব্বা রাজশাহীর বাঘা উপজেলার কয়েকটি হাট থেকে গুড়চাষি কৃষকদের থেকে খেজুর গুড় কিনে ট্রেনে করে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় পাঠাতেন। তিনি লিখতে জানেন না। তাই আমাকে সঙ্গে নিতেন চাষিদের স্লিপ লিখে টাকার পরিমাণ হিসাব করে দেওয়ার জন্য।
ফলের কার্টনে খড় ও পুরোনো কাগজের পত্রিকা দিয়ে গুড় প্যাকেটজাত করা হতো। পুরোনো পত্রিকা থেকে আমার পছন্দের পাতাগুলো ছিঁড়ে জমিয়ে রাখতাম। সেগুলো বাড়িতে নিয়ে এসে পড়তাম। সে সময়ই আমার প্রথম আলোর সঙ্গে পরিচয়।
রেডিও শোনা, পত্রিকা পড়া—পড়ালেখার বাইরে এসবই ছিল আগ্রহের জায়গা।
প্রচুর গান শুনতাম। আমাদের এলাকায় সে সময় সংবাদপত্র পাওয়া যেত না। ২০০৯ সালের দিকে পাশের ইউনিয়নের একজন হকারকে অনেক অনুরোধ করে বাড়িতে প্রথম আলো দিতে বলি। বৃত্তির টাকা দিয়ে পত্রিকার বিল দিতাম। কী মধুর সেসব স্মৃতি!
বাংলাদেশ বেতারের আয়োজনে একটা রিয়েলিটি শো হতো। নাম ‘উত্তরণ জিনিয়াস’। এই রিয়্যালিটি শোতে অংশ নিয়ে সারা দেশের হাজারো অংশগ্রহণকারীর মধ্য থেকে সেরা হই। ২০১০ সাল, মাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষার আগের দিন ঢাকার আগারগাঁও যেতে হয়েছিল লাইভ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। সেবারই প্রথম আমার রাজধানী দেখা।
বিভিন্ন পুরস্কারের টাকা জমিয়ে একটি জাভা সাপোর্টেড ফোন কিনেছিলাম। সেটা দিয়েই ইন্টারনেটের সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। গুগল সার্চ করতাম কারণে–অকারণে। ইন্টারনেট ব্যবহার করাটা কেমন জানি নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল।
কলেজে প্রথম বর্ষে থাকাকালে ‘ইন্টারনেট উৎসব’ নামে একটি প্রতিযোগিতার খবর পাই। স্কুল-কলেজে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ আয়োজন করেছিল গ্রামীণফোন ও প্রথম আলো। ২০১১ সালে আমার উপজেলা বাঘায় সে উৎসব থেকে আমি ‘আই-জিনিয়াস’ নির্বাচিত হই। প্রথম আলোয় আমার ছবি আসে, ঢাকায় জিপি হাউসে গ্র্যান্ড ফিনালেতে অংশ নেওয়ার সুযোগও পাই। ২০১২ সালেও রাজশাহী সদরে আমি দ্বিতীয়বারের মতো ইন্টারনেট জিনিয়াস হয়েছিলাম।
নিজে নিজে শেখা
২০১৩ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ নিয়ে কলেজ শেষ করেও খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম। কারণ, আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সামর্থ্য পরিবারের ছিল না। নানা জায়গায় কাজের সুযোগ খুঁজতে খুঁজতেই এক বছর কেটে গেল।
খুব ভেঙে পড়েছিলাম। হতাশা জেঁকে বসেছিল। আব্বাকে বলে অনেক কষ্টে কম টাকায় একটি পুরোনো ল্যাপটপ কিনে ফেলি সে সময়। তখন রাজশাহীতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ছিল না।
ঢাকায় চলে আসি। আমার এক মামা, মো. শামসুজ্জামান সে সময় তাঁর বাসায় থাকার ব্যবস্থা করে দেন। এই মানুষটির কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। মামার বাসায় ইন্টারনেট ছিল। হতাশা ঝেড়ে নতুনভাবে শুরু করি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রস্তুতি। সেই সঙ্গে চলছিল ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শেখা।
খুব চেয়েছিলাম কম্পিউটার–সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে পড়ব। সুযোগ হয়নি। শেষ পর্যন্ত ভর্তি হই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি সে সময় ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ও ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের দক্ষতা আয়ত্ত করতে শুরু করি। অল্প কিছু ডলারও আয় হচ্ছিল তখন।
আমার পড়ালেখার বিষয়ের সঙ্গে কোডিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং, এসবের কোনো সম্পর্ক ছিল না। তবু, যেখান থেকে পারি, যেভাবে পারি শিখেছি।
‘রাজশাহী এক্সপ্রেস’ নামে রাজশাহীকেন্দ্রিক একটি ইন্টারনেট মিডিয়া চালু করি সে সময়। তৈরি করি ছোট্ট একটা দল। উইকিপিডিয়া, গুগল ম্যাপ, গুগল ট্রান্সলেট, নানা জায়গায় প্রদায়ক হিসেবে কাজ করতাম তখন।
২০১৬ সালের কোনো একদিনের কথা। ফেসবুক ব্রাউজ করছিলাম, হঠাৎ চোখে পড়ল, ইউসি ব্রাউজারের ফেসবুক পেজ থেকে বাংলাদেশ নিয়ে একটি পোস্ট করা হয়েছে। কৌতূহলী হয়ে পেজে মেসেজ করে বসলাম। লিখলাম, ‘আপনারা বাংলাদেশ নিয়ে কাজ শুরু করেছেন জেনে খুব ভালো লাগছে। আমি নিয়মিত ইউসি ব্রাউজার ব্যবহার করি। এ যাত্রায় যদি কোনোভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি, তাহলে ভালো লাগবে।’ কয়েক দিন পরই ফিরতি বার্তায় আমার সিভি চাওয়া হলো!
দেশে বসে বিদেশের কাজ
সে সময় আমার কোনো সিভি ছিল না। তড়িঘড়ি করে গুগল থেকে শিখে নিয়েছিলাম, কীভাবে সিভি বানাতে হয়, কী কী থাকতে হয়। দু-এক দিনের মধ্যে সিভি পাঠিয়ে দিলাম। ফিরতি বার্তা এল পরদিনই। তাঁরা আমার সিভি পছন্দ করেছেন এবং আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চান!
এরপর সাক্ষাৎকার পর্ব হলো। কাজও করতে শুরু করলাম। তখন আমার খুব বেশি দক্ষতা ছিল না। যেসব কাজ পারতাম সেগুলো করতাম। না পারলে ইন্টারনেট ঘেঁটে শিখে ফেলতাম। তাঁরাও খুব আন্তরিকতার সঙ্গে আমাকে সাহায্য করেছেন। এভাবে কাজ করেছি প্রায় চার বছর। ভালো কাজের জন্য আমি ইউসি ব্রাউজার বাংলাদেশের শুভেচ্ছা দূত উপাধিও পেয়েছিলাম।
বাংলাদেশি ব্যবহারকারীদের জন্য আলাদাভাবে ইউসি নিউজ, ইউসি ক্রিকেট এবং অন্যান্য স্থানীয় সেবা চালু করেছিলাম আমরা। অনেক স্মৃতিই এখনো চোখে ভাসে।
এরপর একে একে নানা উদ্যোগ, নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছি। ক্লাসের পড়া সামলে এত কিছু করতে কত যে পরিশ্রম করতে হতো! তবু জাহাঙ্গীরনগরে একটা অসাধারণ সময় কেটেছে।
২০১৯ সালে দেশে বসেই সিঙ্গাপুরের একটি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করি। ব্লকচেইন, ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং ডিসেন্ট্রাইলাইজড ফিন্যান্স নিয়ে কাজ করত তারা। সেখান থেকে আমার এই উদীয়মান খাত সম্পর্কে ধারণা হয়। ডিজিটাল মুদ্রা বা ডিজিটাল কারেন্সি যে ভবিষ্যতের একটি বড় উপাদান হয়ে উঠবে, সেটা বুঝতে পারি। পরে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান সি-গ্রুপের গেম পাবলিশার ও ডেভেলপার ‘গ্যারেনা’তেও কাজ করেছি।
দক্ষতাই শক্তি
স্পটিফাইতে আমার পদবি ‘এডিটোরিয়াল কো-অর্ডিনেটর’। আমি গ্লোবাল মিউজিক টিমের একজন সদস্য। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সংগীতের বাজার নিয়ে আমার কাজ। এ অঞ্চলের ব্যবহারকারীরা ঠিক কোন ধরনের মিউজিক বা অডিও শুনতে চান, বিভিন্ন উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আমাকে সেটা বুঝতে হয়।
আমি সব সময় চেষ্টা করেছি নিজের ইচ্ছাগুলোকে প্রাধান্য দিতে, ‘ডিজিটাল’ বিষয়টা বুঝতে, দক্ষতা বাড়াতে।
অনেক সময় মনে হতো, আমি যেসব নিয়ে কাজ করি, এটি একটি অনিশ্চিত ক্ষেত্র। কখনো ভালো কিছু করতে পারব কি না, কে জানে! এসব ভেবে কখনো কখনো বিসিএস কিংবা একটি নবম গ্রেডের চাকরির কথাও ভেবেছি। কিন্তু সে পথে আর হাঁটা হয়নি।
আমি মনে করি, ইন্টারনেট একটা বড় শক্তি। এখান থেকে যে কেউ নিজে নিজে শিখতে পারে, স্বপ্নের চেয়েও উঁচু স্থানে পৌঁছতে পারে। প্রয়োজন শুধু পরিশ্রম আর ধৈর্য।