বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবিতে সংগঠিত ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়। সঙ্গত কারণেই ভাষা আন্দোলন ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মায়ের ভাষা রক্ষায় ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি রাজপথে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ আরও অনেকে শহীদ হন।
এই আন্দোলনে রাজশাহীর সর্বস্তরের পেশাজীবী, ছাত্র-জনতার গৌরবময় ভূমিকা ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো-ভাষা শহীদদের স্মরণে রাজশাহীতেই দেশের প্রথম শহীদ মিনারটি তৈরি হয়েছিলো!
রাজশাহীবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি দেশের প্রথম শহীদ মিনার হিসেবে এটিকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হোক। স্বীকৃতির জন্য রাজশাহীর মানুষ আন্দোলনও করেছেন দীর্ঘদিন।
বায়ান্নের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার রাজপথে ভাষার দাবিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন তুঙ্গে। রাজশাহীতেও ভাষার দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পাকিস্তানি সরকারি বাহিনীর গুলিতে বহু ছাত্র হতাহত হন। সেই খবর পেয়ে সন্ধ্যার দিকে রাজশাহী কলেজে জমায়েত হন ছাত্ররা।
রাজশাহীর ভাষাসৈনিকদের ভাষ্যমতে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলি করে ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে—এমন একটি খবর রাজশাহীতে আসে সন্ধ্যায়। রাজশাহীর মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের টেলিফোনে খবরটি আসার পর তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ভাষার দাবিতে আন্দোলনকারীদের বুকে গুলি চালানোর খবরে সোচ্চার হয়ে ওঠে রাজশাহীর ছাত্র-জনতা। ওই রাতেই রাজশাহী কলেজের এ ব্লকের আবাসিক শিক্ষার্থী গোলাম আরিফ টিপুর কক্ষে সভা হয়। সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয় শহীদদের সম্মানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের।
কিন্তু তখনকার দিনে শহীদ মিনার বা স্মৃতিস্তম্ভ সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা ছিলো না। এরপরও রাত সাড়ে নয়টায় শুরু হলো নির্মাণকাজ। পাশেই ছিল হোস্টেল নির্মাণের জন্য ইট-কাঠ। সেই ইট-কাঠের সঙ্গে কাদামাটি মিশিয়ে রাত ১২টার মধ্যে নির্মিত হয় দেশের প্রথম শহীদ মিনার। তখন মাটিতে কালি দিয়ে দিয়ে লিখে দেওয়া হয়েছিল ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’। এভাবেই রচিত হয়েছিল মহান ভাষাশহীদদের সম্মানে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারের ইতিহাস। কিন্তু পরদিনই ২২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পুলিশ শহীদ মিনারটি ভেঙে দেয়।
যদিও ভাষাসংগ্রামী ও গবেষক আহমদ রফিক রাজশাহীতে একুশের রাতে নির্মিত ওই স্মৃতিস্তম্ভকে শহীদ মিনার নয়, শহীদ মিনার নির্মাণের প্রথম প্রয়াস বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের বন্ধু-বান্ধবের অনেকে এই প্রয়াসটিকে মানতে চান না। আমি মানি। কারণ প্রচেষ্টাটা ছিল প্রথম। এটা ছিল কাদামাটি আর কয়েকটা ইট দিয়ে তৈরি করা খুব ছোটখাটো একটি স্তম্ভ। আমরা ঢাকায় শহীদ মিনার নির্মাণ করেছি এর একদিন পর ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে। সাড়ে ১০ ফুট উঁচু, ছয় ফুট চওড়া। রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত সময় লেগেছিল আমাদের।’ আহমদ রফিক আরও বলেন, ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি নড়াইল শহরের বোর্ডিং হাউস প্রাঙ্গণেও একুশের রাতে কাদামাটি দিয়ে একই রকম একটি মিনার করার কথা জানতে পেরেছেন। তার মতে, প্রথম প্রচেষ্টাগুলোর স্বীকৃতি দিলে শহীদ মিনারের গৌরব ক্ষুণ্ন হয় না।
এর আগে দেশের প্রথম শহীদ মিনারের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবির পক্ষে রাজশাহী কলেজে অনলাইন ভোটিং কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক ওয়ালিউর রহমান বাবুর মতে, ‘বায়ান্নের আগে থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন রাজশাহী কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা। ঢাকার ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে তাল রেখে রাজশাহীর ভাষা আন্দোলন পরিচালিত হতো বৃহৎবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী এ কলেজ থেকেই। ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ হয় এই চত্বরেই। এটিই দেশের প্রথম শহীদ মিনার। আমরা এর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চাই।’
জানা যায়, শিক্ষার্থীদের সামনে ভাষা আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস জীবন্ত করে তুলতে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেন রাজশাহী কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান। এরপর ২০০৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ঘটা করে প্রথম শহীদ মিনারের স্থানে শ্রদ্ধাস্মারক নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন রাজশাহী সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। এরপর বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি চালাচালি করেন অধ্যক্ষ মহা. হবিবুর রহমান। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশার কাছে। এরপর ২০১৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমানের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে বরাদ্দের চিঠি তুলে দেন এমপি।
প্রথম শহীদ মিনারের স্থলে ৫২ ফুট উচ্চতার নতুন মিনার নির্মাণের কথা ছিল। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর এমপি ফজলে হোসেন বাদশাকে নিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণকাজের উদ্বোধনও করেন মেয়র লিটন। কিন্তু অর্থ বরাদ্দ জটিলতায় থমকে যায় নির্মাণকাজ। ফিরে যায় সেই বরাদ্দকৃত অর্থ। আবারো অর্থ বরাদ্দ মেলে। এছাড়া যে জায়গায় শহীদ মিনার নির্মাণের কথা ছিল সেখানে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। ফলে একটু দূরে সরে গিয়ে রাস্তার পাশে জায়গা নির্ধারণ করা হয়।
রাজশাহীর ভাষা সৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী বলেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহী কলেজ মুসলিম ছাত্রাবাসের প্রধান ফটকের পাশে দেশের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছিল। পরে সেটি তৎকালীন পুলিশ বাহিনী গুঁড়িয়ে দেয়। এটিই বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার, যা ঐতিহাসিকভাবে সত্য।
একুশে পদক প্রাপ্ত মরহুম লেখক ও সাংবাদিক সাঈদ উদ্দিন আহমদ এর লেখা থেকে জানা যায়, রাজশাহী মেডিকেল স্কুলের সিনিয়র ছাত্র এস এম গাফ্ফারের সভাপতিত্বে সভায় দুটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। তার মধ্যে শহীদ ছাত্রদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ করাটাও একটা। ইট ও কাদামাটি দিয়ে যেভাবেই হোক রাতেই শহীদদের স্মরণে একটি শহীদ মিনার তৈরি করতে হবে বলে সবাই সিদ্ধান্ত নিলো। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক হলেন রাজশাহী কলেজের ছাত্র গোলাম আরিফ টিপু (মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর)। ভাষাসৈনিক সাঈদ হায়দার সেই রাতের সিদ্ধান্তে একদিনের মধ্যে তৈরি হলো মিনার, লেখা হলো ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’। আর দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হলো একটি চরণ-‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই। নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান,ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’সেখানে উপস্থিত গোলাম আরিফ টিপু বলেন, কোথা থেকে একটা ভাঙাচোরা ক্যামেরা এনে সেইদিন ছবিও তুলে রাখা হয়েছিল।
এদিকে আমরা সারা রাত জেগে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করি। পরদিন সকালে হরতালের পিকেটিং করার জন্য আমরা সবাই হোস্টেল থেকে বেরিয়ে পড়ি। এ সময় পুলিশ এসে শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলে। আমরা খবর পেয়ে বিকেলে এসে দেখি, পুলিশ শহীদ মিনারটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।’ ২০১৩ সালে জীবিত থাকাকালে এই ভাষা সৈনিককে প্রথম শহীদ মিনারের স্মৃতি নিয়ে জিজ্ঞেস করা হলে গণমাধ্যমকে তিনি আরও বলেছিলেন, ‘কে আগে আর কে পরে এটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না, তবে এটা সত্য রাজশাহী কলেজ ছাত্রাবাসের সামনে আমরা একদিনেই শহীদ মিনার তৈরি করে ফেলি। সিদ্ধান্তটা ২১ তারিখেই ছিল। এটাই যে প্রথম শহীদ মিনার সেটা প্রমাণে আমরা কখনও আর এগোয়নি।’
কিন্তু সঠিকটা জানানোর জন্য ইতিহাসের কিছু দায় থাকে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘অবশ্যই ইতিহাসের দায় আছে এবং এটাই সত্য যে, সময়ের হিসাব করলে রাজশাহীর শহীদ মিনারটি আগে হয়েছিল।’ উল্লেখ্য, ভাষাসৈনিক সাঈদ হায়দার ২০১৪ সালের ভাষার মাসের ২৮ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।
ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় এখনো রাজশাহীতে যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের দীর্ঘদিনের দাবি, দেশের প্রথম শহীদ মিনার হিসেবে এটিকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হোক। মূলত এই দাবির প্রেক্ষিতেই ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর নতুন করে সেই শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এরও আগে ২০০৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান প্রথম শহীদ মিনারের স্মৃতি রক্ষার জন্য একটি ‘শ্রদ্ধাস্মারক’ ফলক স্থাপন করেছিলেন।
মহান ভাষা আন্দোলনে রাজশাহীবাসীর গৌরবময় ভূমিকা চিরস্মরণীয় করে রাখতে প্রথম শহীদ মিনারের স্বীকৃতি তাই রাজশাহীবাসীর প্রাণের দাবি।