দূর থেকে হঠাৎ দেখলে মনে হবে এক বিশাল রাজপ্রাসাদ যাতে খয়েরি সাদা রঙের ভবনে রাজকীয় আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। এগিয়ে একটু ভেতরে গেলে দেখা মিলবে সরোবরে ফুটে আছে লাল-সাদা শাপলা, নানা জাতের ফুল। পাঠক, এটি কোনো বাসভবন নয়, দেশসেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘রাজশাহী কলেজ’!
কলেজের মনোরম পরিবেশের সঙ্গে শিক্ষক- শিক্ষার্থীর নিবিড় যোগাযোগ যেন শিক্ষার্থীদের আরও ভালো করার উৎসাহ যুগিয়েছে কলেজটিতে। আর তাতেই এমন ‘বিস্ময়কর’ সাফল্য।
গতবছর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ র্যাংকিং ২০১৮-এর ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। টানা চতুর্থবারের মতো আবারও দেশসেরা উত্তরবঙ্গের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত রাজশাহী কলেজ। ২০১৫ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে দেশ সেরা হওয়ার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে এই বিদ্যাপিঠ।
ঢাকা কলেজ ও চট্টগ্রাম কলেজের পর রাজশাহী কলেজ দেশের তৃতীয় প্রাচীন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের ৬৮৫টি কলেজের ২০১৫ সালের তথ্যের ভিত্তিতে রাজশাহী কলেজ বাংলাদেশের সেরা কলেজ হিসেবে নির্বাচিত হয়। বাংলাদেশে এই কলেজ থেকেই সর্ব প্রথম মাস্টার্স ডিগ্রি প্রদান করা শুরু হয়।
রাজশাহী কলেজের সাফল্যের পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছেন সাবেক অধ্যক্ষ মহা. হবিবুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনেও টানা চারবার দেশসেরা হয়েছে এই কলেজ। তাঁকে বলা হয় আধুনিক রাজশাহী কলেজের রূপকার। তিনি ২০১৪ সালের আগস্ট মাস থেকে ২০২১ সালে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টানা চারবার সেরা হয়েছে রাজশাহী কলেজ, পেয়েছে মডেল কলেজের খেতাবও।
কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতে রাজশাহী কলেজের ধারাবাহিক সাফল্যের পেছনে সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক মহা. হবিবুর রহমানের দূরদর্শী নেতৃত্বের বড় ভূমিকা রয়েছে। রাজশাহী কলেজকে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীবান্ধব করতে তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সর্ম্পককে সুদৃঢ় করেছেন, শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন। সর্বোপরি পুরো ক্যাস্পাসকে শিক্ষার্থীবান্ধব করে সাজিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের প্রয়োজনগুলো বোঝার চেষ্টা করেছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের মনোজগতের ইতিবাচক পরিবর্তনের চেষ্টা চালিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ, শৃঙ্খলাবোধ শিখিয়েছেন। ক্লাস রুমের ভেতর থেকে বাইরে সবকিছুর সার্বক্ষণিক তদারকি করেছেন। শুধু তাই নয়, শিক্ষকদের আন্তরিকভাবে পাঠদানেও উৎসাহিত করেছেন। আর এসব কারণেই রাজশাহী কলেজ শ্রেষ্ঠ ও মডেল বিদ্যাপিঠ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
রাজশাহী কলেজের পরিবেশ, পাঠদান পদ্ধতি, শিক্ষকদের আন্তরিকতা ও শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন দেখানোর যে প্রেষণা সেটা নিঃসন্দেহে অন্য কলেজগুলোর চেয়ে ভিন্ন। সে কারণে রাজশাহী কলেজ স্বাতন্ত্র্য একটি জায়গা পেয়েছে। এক্ষেত্রে রাজশাহী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মহা. হবিবুর রহমানের প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দক্ষতা প্রশংসনীয়ই শুধু নয়, অনুকরণীয়।
রাজশাহী কলেজের শিক্ষকগণ সবসময় চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীদের আন্তরিকভাবে পাঠদান করতে, এতে শিক্ষার্থীরা তাদের সমস্যাগুলো সহজেই শিক্ষকদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে। এছাড়া কলেজ প্রশাসনও অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে।
পড়াশোনার বাইরে বুদ্ধিভিত্তিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অংশ গ্রহণেও তৎপরতা লক্ষ্যণীয়। সর্বোপরি একজন শিক্ষার্থীকে সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয় সম্মিলিতভাবে। এ কারণেই জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ হওয়ার গৌরব।
কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক মহা. হবিবুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, “যে কোনও কাজের প্রতি ভালোবাসা, একাগ্রতা, সততা ও স্বচ্ছতা থাকতে হয়। আমি সেটা করার চেষ্টা করেছি। রাজশাহী কলেজের সার্বিক উন্নতির জাদু সর্ম্পকে অনেকেই জানতে চান। এক কথায় বলতে গেলে, আমরা শিক্ষার্থীদেরকে ইতিবাচকভাবে বদলে যেতে দেখেছি। আমরা শিক্ষার্থীদের সুযোগ করে দিয়েছি, প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছি। যা অনেক প্রতিষ্ঠানই পারেনি।”
অন্যদিকে রাজশাহী কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহা. আব্দুল খালেক গণমাধ্যমকে জানান, “রাজশাহী কলেজ সব সময় শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। আজকের এই সাফল্যের পেছনে সাবেক অধ্যক্ষের বড় ভূমিকা রয়েছে। সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সাফল্যের মাত্রাকে আরও উচ্চস্তরে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে কাজ চলছে।”
শিক্ষার্থীদের মেধার উৎকর্ষতা সাধনে দক্ষ শিক্ষকদের মাধ্যমে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুমসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে কাজ করা হচ্ছে। রাজশাহী কলেজের এই সাফল্যে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শুভাকাঙ্খী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ইতিবাচক প্রচেষ্টা রয়েছে।
উল্লেখ্য ১৮৭৩ সালে ৩৫ একর এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী কলেজ। বর্তমানে এখানে ২৪টি বিভাগে প্রায় ৩২ হাজার শিক্ষার্থী ও ২৫৭ জন শিক্ষক রয়েছেন। কলেজের ৯১টি ক্লাসরুমে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর লাগানো হয়েছে। শিক্ষকদের দেওয়া হয়েছে ৪৫৫টি কম্পিউটার। তা ছাড়া বিশেষায়িত শ্রেণিকক্ষ (বিজ্ঞান ল্যাব, কম্পিউটার ল্যাব) রয়েছে ২৩টি।
কলেজ কর্তৃপক্ষ সব সময়ই ক্লাসে উপস্থিতির জন্য উৎসাহিত করেন। শিক্ষার্থীরা মনে করেন, এটাই তাঁদের বড় শক্তির জায়গা। ক্লাসে উপস্থিত থাকার ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় ব্যানার লাগানো হয়েছে। নির্ধারিত সংখ্যক ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে অভিভাবকসহ শিক্ষার্থীদের ডেকে ক্লাসে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়।
সেরা কলেজ হওয়ার পেছনে কারণ আছে আরও। শিক্ষার্থীরা এখানে বিনা মূল্যে ওয়াই-ফাই সুবিধা পান। প্রশাসন ভবনের দোতলায় লাগানো হয়েছে এলইডি সাইনবোর্ড, যার মাধ্যমে কলেজের যাবতীয় তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কলেজটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে বিভিন্ন জায়গায় ডাস্টবিন বসানো হয়েছে। গাছে গাছে লাগানো হয়েছে নামফলক। ধূমপানমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে কলেজ ক্যাম্পাস। পড়াশোনার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমেও এগিয়ে রয়েছে রাজশাহী কলেজ। এখানে ২৮টি সংগঠন সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
সঙ্গত কারণে সেরার স্বীকৃতি পাওয়ার পর রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী- শিক্ষকগণের দায়িত্ব বেড়ে গেছে। কেননা তাঁরা ভালোমতোই জানেন, মুকুট অর্জনের চেয়ে সেটি রক্ষা করা কঠিন। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা যুগ-যুগান্তর বজায় থাকবে এমনটাই প্রত্যাশা রাজশাহী কলেজ সংশ্লিষ্ট সকলের।