মূলত কালাই রুটি হলো বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী খাবার। এটি সংরক্ষণযোগ্য খাবার যা মাষ কলাই ও আতপ চালের আটা বা ময়দা, লবণ এবং পানি দিয়ে তৈরি করা হয়।
বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় কালাই রুটির উৎপত্তি বলা যায়। এই অঞ্চলে মাছ-ভাত-ডালের মতই বহুল প্রচলিত খাবার, শহরের প্রায় সকল জায়গায় চোখে পড়বে কালাই রুটির দোকান। এই জেলা ছাড়াও উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, নওগাঁ এবং ঢাকাতেও কালাই রুটি দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
কালাই-রুটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী খাবার হলেও তা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে রাজশাহী নগরে। আপনি ভোজনরসিক, রাজশাহী নগরেও গিয়েছেন, অথচ একবার হলেও কালাই-রুটি পাতে নিয়ে বসেননি– দুঃখিত পাঠক, আপনার জন্য আফসোস হচ্ছে!
বর্তমানে রাজশাহী নগরে কালাই-রুটির অন্তত ১০০টি দোকান গড়ে উঠেছে। দোকানগুলোর নামও বেশ চমৎকার। কালাইঘর, কালাইবাড়ি, হাঁরঘে কালাই–এমন বাহারি সব দোকান রয়েছে নগরীর মোড়ে-মোড়ে। সকাল থেকে রাতদুপুর অবদি খোলা থাকে এসব দোকান।
কালাই রুটির সাথে সাধারণত বেগুন ভর্তা, শুকনো মরিচ ভর্তা, বট, পেঁয়াজ ভর্তা, মাংস ভুনা ইত্যাদি দিয়ে পরিবেশন করা হয়। এসবের সাথে রুটির টুকরো ছিড়ে গরম গরম খাওয়া হয়।
কয়েকবছর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও রাজশাহী এসে পুষ্টিকর ও মুখরোচক এই কালাই-রুটির স্বাদ নিয়ে যান। এই বিশেষ খাবারের কারণে তিনি রাজশাহী শহরকে ভালোবেসে ফেলেছেন বলে সেময় মন্তব্য করেছিলেন। কালাই-রুটি খাওয়ার জন্য হলেও তিনি রাজশাহী শহরে আবার আসতে চান বলেও জানিয়েছিলেন।
ওবায়দুল কাদের কালাই রুটি খেয়েছিলেন রাজশাহীর সিএন্ডবি মোড়ের একটি দোকান থেকে। সেখানে আম বাগানের পাশেই ছাউনি দিয়ে দোকান তৈরী করা এবং বসার জন্য আছে বেঞ্চ ও চেয়ার। সবাই তাকে খালা বলে সম্বোধন করেন। উনার সাথে কথা বলে জেনেছি দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর যাবৎ তিনি এই দোকানে বসেন এবং কালাই রুটি তৈরি করেন।
খালা জানিয়েছিলেন, মাষকলাইয়ের ডাল আর আতপ চালের আটা দিয়ে তৈরি হয় এই কালাই-রুটি। দুটি রুটি তৈরি করতে আনুমানিক আড়াইশ গ্রাম কলাই আর একশ গ্রাম চালের আটা লাগে। রুটির একটা পাশ হয় নরম। আরেকপাশ হয় কুড়মুড়ে। কালাই-রুটির প্রকৃত স্বাদ পেতে হলে তা অবশ্যই গরম অবস্থায় খেতে হবে।
খালার দোকানে সর্বদা ভিড় থাকে। একটার পর একটা রুটির সিরিয়াল চলতেই আছে। এক টুকরো খামির নিয়ে হাতের মাধ্যমে গোল করে পাশেই মাটির উনুনে তৈরি করে ফেলছেন মজাদার কালাই রুটি। কেউ খাচ্ছেন মরিচ ভর্তা দিয়ে আবার কেউ বেগুন ভর্তা।
দোকানে নবদম্পতির সাথে দেখা হলো। তাদের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, ছেলেটি রাজশাহীরই কিন্তু মেয়েটি যশোরের। তাদের দুজনেরই কালাই রুটি অনেক পছন্দ এবং তারা প্রায়ই আসেন খালার হাতের কালাই রুটি খাওয়ার জন্য।
কালাই-রুটি দিয়ে এখন রাজশাহীতে অতিথি আপ্যায়নও করা হয়। মেয়র, পুলিশ কমিশনার, ডিসি ও এসপি’র বাসায় বাইরের কোনও অতিথি এলে সেখানে কালাই-রুটি বানিয়ে খাওয়ানো হয়। এছাড়া, বড় অনুষ্ঠানে অন্যান্য খাবারের সাথে কালাই-রুটি যেন মূল অনুসঙ্গ হয়ে গেছে।
কালাই রুটির দাম –
কালাই রুটির দাম সাধারণত ২৫ টাকার মধ্যেই হয়। তবে কোন কোন স্থানে বিশেষ কালাই রুটি বানানো হয়, যার মূল্য ৫০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
ঢাকায় কালাই রুটি-
এখন ঢাকায়ও কিছু জায়গায় কালাই রুটি পাওয়া যায়। ২১/৯ তাজমহল রোডে আছে ‘কালাই ঘর’, শ্যামলী শাহি মসজিদের সামনে ও মিরপুর স্টেডিয়ামের পাশের দোকানে এবং উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরে রিকশাভ্যানের ওপর কালাইর রুটি পাওয়া যায়। এগুলোতে হাঁসের মাংস ভুনাসহ সব আনুষঙ্গিক দিয়েই কালাই রুটি খেতে পারবেন।
কালাই রুটির রেসিপি :
প্রথমে মাষকালাই ও আতপ চাল পাটাতে বা যাঁতাতে পিষে আটা বানানো হয়। মেশিনে তৈরী আটা দিয়েও কালাই রুটি বানানো গেলেও পাটায় পিষ্ট আটা দিয়ে কালাই রুটি বানালে স্বাদ বৃদ্ধি পায়। এর সাথে স্বাদমতো লবণ ও প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি মিশিয়ে খামির তৈরী করা হয়। খামির থেকে ছোট বল পরিমাণ আটা নিয়ে গোলাকার করা হয়। এরপর দুই হাতের তালুতে রেখে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বড় রুটি বানানো হয়। সাধারণত গমের রুটির চেয়ে কালাই রুটি অধিক পুরু এবং বড়। এরপর রুটিটিকে মাটির তাওয়াতে সেঁকে গরম করা হয়। রুটির রঙ বাদামী হয়ে গেলে নামিয়ে নেওয়া হয়।
আমের শহর, রেশমের শহর কিংবা শিক্ষার নগরী হিসেবে রাজশাহীর খ্যাতি তো আছেই, তবে শীতকালে রাজশাহীর পরিচয় যেন হয়ে ওঠে কালাই রুটির শহর। রাস্তার পাশে মাটির চুলার ওপর সেঁকা হচ্ছে কালাইয়ের রুটি। গরম-গরম সে রুটি চলে আসছে থালায়। আর বাটিতে আসছে লাল শুকনো মরিচ দিয়ে কষানো ধোঁয়া ওঠা হাঁসের মাংস অথবা কাঁচা মরিচ বেটে তাতে লবণের ছিটে আর কাসুন্দি দেওয়া চাটনি কিংবা ঝাল ঝাল বেগুনভর্তা, ওপরে সরিষার তেল দেওয়া। অসাধারণ! পাঠক, কালাই রুটি খাওয়া নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কী?