বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর শহর রাজশাহী। অনেকের মতে একই সাথে বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন শহরও বটে! রাজশাহী বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী মহানগরী। এটি উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় শহর, যা পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত। বিভাগীয় শহর রাজশাহী বাংলাদেশের শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম বায়ু দূষণের শহর।
কোথাও বেড়াতে গেলে আমরা কেবল দর্শনীয় স্থানই দেখি না। ভোজন রসিক মানুষ নতুন কোনো জায়গায় গেলে খুঁজি সেই স্থানের মজাদার সব খাবার। প্রিয় পাঠক, আপনি যদি কাজের জন্য রাজশাহী আসেন, অথবা বেড়াতে আসেন তাহলে এখানকার বিশেষ কিছু খাবার চেখে দেখতে ভুলবেন না কিন্তু!
পদ্মার তীরের অসাধারণ দৃশ্য উপভোগ করুন, সেই সাথে একবার হলেও খেয়ে দেখুন রাজশাহীর বিশেষ বিশেষ খাবারগুলো। তাই আজকে আপনাদেরকে জানাবো রাজশাহী যেসব খাবারের জন্য বিখ্যাত এবং কোথায় পাওয়া যেতে পারে :
১) রাজশাহীর কালাই রুটি
রাজশাহী যাবেন এবং কালাই রুটি খাবেন না ,তা হতেই পারে না। মূলত কালাই রুটি হলো বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী খাবার। এটি সংরক্ষণযোগ্য খাবার যা মাষ কলাই ও আতপ চালের আটা বা ময়দা, লবণ এবং পানি দিয়ে তৈরি করা হয়।
কালাই-রুটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী খাবার হলেও তা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে রাজশাহী নগরে। আপনি ভোজনরসিক, রাজশাহী নগরেও গিয়েছেন, অথচ একবার হলেও কালাই-রুটি পাতে নিয়ে বসেননি-দুঃখিত পাঠক, আপনার জন্য আফসোস হচ্ছে!
বর্তমানে রাজশাহী নগরে কালাই-রুটির অন্তত ১০০টি দোকান গড়ে উঠেছে। দোকানগুলোর নামও বেশ চমৎকার। কালাইঘর, কালাইবাড়ি, হাঁরঘে কালাই–এমন বাহারি সব দোকান রয়েছে নগরীর মোড়ে-মোড়ে। সকাল থেকে রাতদুপুর পর্যন্ত খোলা থাকে এসব দোকান।
কালাই রুটির সাথে সাধারণত বেগুন ভর্তা, শুকনো মরিচ ভর্তা, বট, পেঁয়াজ ভর্তা, মাংস ভুনা ইত্যাদি দিয়ে পরিবেশন করা হয়। এসবের সাথে রুটির টুকরো ছিড়ে গরম গরম খাওয়া হয়।
কালাই-রুটি দিয়ে এখন রাজশাহীতে অতিথি আপ্যায়নও করা হয়। মেয়র, পুলিশ কমিশনার, ডিসি ও এসপি’র বাসায় বাইরের কোনো অতিথি এলে সেখানে কালাই-রুটি বানিয়ে খাওয়ানো হয়। এছাড়া, বড় অনুষ্ঠানে অন্যান্য খাবারের সাথে কালাই-রুটি যেন মূল অনুসঙ্গ হয়ে গেছে।
কালাই রুটির দাম –
কালাই রুটির দাম সাধারণত ২৫ টাকার মধ্যেই হয়। তবে কোন কোন স্থানে বিশেষ কালাই রুটি বানানো হয়, যার মূল্য ৫০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
স্থান – পুরো শহর জুড়েই ছোট-বড় অনেক দোকানে তৈরি হয় কালাই রুটি। তবে কালাই রুটির জন্য বেশ জনপ্রিয় জায়গা হল রাজশাহীর নিউমার্কেটের রূপালী ব্যাংকের উল্টাদিকে অবস্থিত ‘কালাই হাউজ’।
২) বাটার মোড়ের জিলাপি
জিলাপি অনেক জায়গায়তেই খেয়ে থাকবেন আপনারা, কিন্তু রাজশাহী শহরের বাটার মোড়ের জিলাপির মতো হবে না! প্রায় ৬৬ বছর ধরে বাটার মোড়ে ছোট একটি দোকানে চলে আসছে বিখ্যাত এই জিলাপির আয়োজন। কোনো সাইনবোর্ড বা বিজ্ঞাপন ছাড়াই এই দোকানে ভিড় করে জিলাপি খেতে আসেন অসংখ্য মানুষ।
জিলাপির দাম –
রসে টইটম্বুর এসব জিলাপি কেজি প্রতি ১২০ টাকা করে বিক্রি হয়। কেবল রাজশাহীই না, আশে পাশের বিভিন্ন জেলার মানুষের কাছে ‘বাটার মোড়ের জিলাপি’ এক নামে জনপ্রিয়।
স্থান – রাজশাহীর জিরো পয়েন্ট থেকে ২৫০ গজ দূরে বাটার দোকানের পাশেই এটি অবস্থিত।
৩) রাজশাহীর কালাভুনা
রাজশাহীর আরেক বিখ্যাত খাবার হল গরুর মাংসের কালাভুনা। দেশের বিভিন্ন স্থানে কালাভুনা পাওয়া গেলেও রাজশাহীতে কাটাখালি জায়গাটি কালাভুনার জন্য সবার কাছে বেশ পছন্দের। রাজশাহীর এই কালাভুনা অন্য স্বাদের ,অন্য মাত্রার। একবার খেলে বারবার খেতে ইচ্ছে করবে আপনার।
স্থান – এখানে অনেক দোকান রয়েছে। রাজশাহীর সিটির হাট, নওহাটা বেশ কিছু দোকান আছে। তবে স্থানীয় এবং আগত সবার কাছে সবচেয়ে পছন্দের কালাভুনা খাওয়ার দোকান হল ‘একতা হোটেল’। কাটাখালি পাওয়ার হাউজের উল্টাদিকে অবস্থিত এই দোকানটি।
দাম- মাংসের দাম প্রতি বাটি ১৬০ টাকা করে যেখানে থাকবে ১০ পিস মাংস এবং হাফ বাটি ৮০ টাকা থাকবে ৫ পিস মাংস। চেটেপুটে খাওয়ার মত এই কালাভুনার স্বাদ নিতে হলে আপনাকে রাজশাহীতে আসতেই হবে।
৪) গরম গরম মিষ্টি
দোকানের নাম “রানা মিষ্টি ঘর”। বিকালে গরম গরম মিষ্টি খেতে হলে আপনাকে যেতে হবে সিএন্ডবি। এই মোড় ছাড়িয়ে নদীর দিকে যেতেই ছোট একটি দোকান কিন্তু বিকালে দোকানের অবস্থা থাকে জমজমাট। ৩০ বছরের পুরাতন এই দোকানে মানুষ ভিড় করে শুধুমাত্র গরম মিষ্টি খাওয়ার জন্য।
গরম মিষ্টির সাথে পুরি খাবারের স্বাদ আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয় এবং মিষ্টির সাথে পুরিই এই দোকানের ঐতিহ্যবাহী খাবার। দোকানে গেলেই দেখতে পাবেন বড় কড়াইয়ে গরম গরম চিনির সিরার মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে ছানার গোল্লার আকারে মিষ্টি।
দাম – প্রতি কেজি মিষ্টির দাম ২০০ টাকা। আর ১ পিস এর দাম ১৫ টাকা।
স্থান – জিরোপয়েন্ট থেকে দোকানের দূরত্ব হবে প্রায় ২ কিলোমিটার। অটো বা রিক্সাযোগে যেতে পারবেন।
৫) বট পরোটা
বট অর্থাৎ গরুর ভুড়ি সেদ্ধ করে বিভিন্ন মশলামিশ্রিত করে মচমচে করে ভেজে পরোটা দিয়ে খাওয়া হয়। স্ট্রিটফুড হিসেবে বট পরোটা রাজশাহীর তরুণ প্রজন্মের কাছে অনেক জনপ্রিয়। বিকেল হলেই ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়েন দোকানে এবং বেচাকেনা চলে মাঝরাত পর্যন্ত।
দাম- প্রতি প্লেট বট বিক্রি হয় ৫০ টাকা দিয়ে। হাফ প্লেটের দাম ২৫ টাকা। প্রতিটি পরোটার দাম ১০ টাকা।
স্থান – শহরের বিভিন্ন স্থান এবং হোটেলে বট বিক্রি হয়। এগুলোর মধ্যে তালাইমারির জামিলের দোকান বেশ জনপ্রিয়। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে এখানে সবকিছু তৈরী হয় এবং দোকানের কর্মচারীদের ব্যবহার ভালো।
এছাড়া ‘বিদ্যুৎ’ হোটেলের শিক কাবাব আর সুখীর রান্না ঘরে লুচি, আলুর দম খেয়ে দেখতে পারেন। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়-এ সিরাজী ভবনের সামনে মাচায় বসে শিক বার্গার খেতে পারেন। এই বার্গারের স্বাদ অন্য সব বার্গার থেকে আলাদা। কয়েকজনের কাছে আমরা জিজ্ঞাসা করেছিলাম তাদের কাছে রাজশাহীর জনপ্রিয় খাবার কোনগুলো। দুইজনের মতামত দেওয়া হলো :
সালমা ইয়াসমিন জানিয়েছেন – “ রাজশাহীর যে খাবারগুলো আমি নিজে টেস্ট করেছি সেগুলোই বলতে চাই। প্রথমেই কালাই রুটি যা না হলেই নয়। বাজারে বেগুন ভর্তা সাথে থাকে, বাসায় করলে ধনে চাটনি দিয়ে টেস্ট করে দেখতে পারেন। সোনাদিঘীর মোড়ের লেবু চা। সিটি কলেজের সামনের গলিটার হোটেলের আলু পুরি(অনেক আগে খেয়েছি, মনে হয় আজও মুখে লেগে আছে)। সিএন্ডবি’র মোড়ে দক্ষিণ দিকে যে রোডটা পদ্মার দিকে এগিয়ে গেছে, ঐ গলির শুরুতেই রানার মিষ্টিঘর থেকে গরম গরম মিষ্টি আর তারই অপজিটে রাস্তার পাশেই তৈরি করা সস্তা বার্গার যা আমার কাছে অমৃত।”
অর্ণ রহমান জানিয়েছেন – “ রাজশাহীর খাবারের তালিকায় প্রথমে বলা যেতে পারে কালাইয়ের রুটির কথা, বেগুন ভর্তা ও মরিচের চাটনি দিয়ে খাওয়া এই রুটি। এছাড়াও জিরোপয়েন্টে এর মরিচ চা, হনুমানজি মন্দির সংলগ্ন ভাজাপোড়া, তালাইমারির বট পরোটা, নিউমার্কেট এলাকায় নূরের হালিম, বেলদার পাড়ার ফুচকা ও শিক বার্গারও বেশ জনপ্রিয়।”
সুতরাং, পাঠক জিভে জল আনা এসব খাবারের স্বাদ নিতে ঘুরে যান রাজশাহী!
১ কমেন্ট
রাজশাহী সিএন্ডবি মোড়ের বাইস্কোপ টি স্টল এর পুদিনা চা অন্যরকম একটা রিফ্রেশমেন্ট 😇