ক্রমবর্ধমান হারে দিন দিন রাজশাহী অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এই শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করায় এই অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার্য পানিসহ সেচের পানি নিয়ে দুর্ভোগের মাত্রা আরও বেড়েছে।
একসময় মনে করা হতো, বোরো চাষে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যায়। তবে গত এক দশকে দেশের উত্তর-পশ্চিমের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের জেলাতে বোরো ধানের আবাদ কমে গেছে। গবেষকেরা জানাচ্ছেন, দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের তিন জেলার পানির স্তর নামছেই। বর্ষা মৌসুমেও এ স্তর স্বাভাবিক অবস্থায় আসছে না।
বাংলাদেশের মিঠা পানির অন্যতম উৎস এবং বরেন্দ্র জনপদ তথা দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেচ প্রকল্পের মূল চালিকা শক্তি পদ্মা নদী। উজানে ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা নদীর স্বাভাবিক গতিধারা অনেকটা পরিবর্তিতত হয়ে গেছে। ফলে এই অঞ্চলের কৃষকদের অতিমাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভর করতে হয় এবং একারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচের দিকে নেমে গেছে। ফলে সরাসরি প্রভাব পড়েছে রাজশাহী তথা বরেন্দ্র অঞ্চলের সার্বিক ইকোসিস্টেমে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৮ সালে যখন দেশে ডিপ টিউবওয়েল বসানো শুরু হয়, তখন সর্বোচ্চ ৫০ ফুট নিচে টিউবওয়েল বসিয়েই পানি পাওয়া যেত। এখন ১৬০ ফুট বসিয়েও পর্যাপ্ত পানি মিলছে না। পানির অযৌক্তিক আহরণ ও মানব সৃষ্ট দূষণে পানির স্তর নিচে নেমে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানি সম্পদের প্রাপ্যতা যাচাই কমিটির সদস্য ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান গণমাধ্যমকে জানান, প্রতি বছর বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এক ফুট করে নিচে নেমে যায়। পরের বছর তা আর ওঠে না।
অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান আরও বলেন, প্রতি বছরই বরেন্দ্র এলাকার পানির স্তর নিচে নামছে। এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তন এর অন্যতম কারণ। আবার বৃষ্টি কম হওয়ায় ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারও দায়ী। এই থেকে উত্তরণের পথ হতে পারে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানো। এতে স্থিতিশীল একটা অবস্থা আসতে পারে। কিন্তু যে স্তর নেমে গেছে, তা ওভারকাম করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে গবেষণা করে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই কর্মসূচি দ্রুতই হাতে নেওয়া দরকার।
এক যুগ আগেও বরেন্দ্র অঞ্চলে ৬০ থেকে ৯০ ফুট মাটির গভীরে সুপেয় পানি পাওয়া যেত। বর্তমানে ১৬০ ফুটের নিচে না গেলে পানি মিলছে না। ঝুঁকিপূর্ণ এসব এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০ থেকে ৪৫ মিটার উঁচুতে। ইতোমধ্যে পানির অভাবে বরেন্দ্র এলাকার অনেক উপজেলায় চাষাবাদ বন্ধ হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমেও এসব এলাকায় পানির স্তর স্বাভাবিক অবস্থায় আসছে না। বরেন্দ্র অঞ্চলে বোরোর চাষ প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেলেও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নামছে। পানির স্তর এভাবে নামার পেছনের কারণ হিসেবে গবেষকরা জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মাছ উৎপাদনসহ নানা কাজে খেয়াল-খুশিমতো গভীর নলকূপ স্থাপন, বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাওয়া, বৃষ্টির তীব্রতার পরিবর্তন, ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন, জলাশয় কমে যাওয়া, পানি পুনর্ভরণ এলাকা কমে যাওয়া এবং শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানির কম প্রবাহকে দায়ী করেছেন।
এ বাস্তবতায় শহর, গ্রাম এবং শিল্প এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমিয়ে বৃষ্টি বা উন্মুক্ত জলাধারের পানির ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ভূ-গর্ভস্থ পানি কম ব্যবহার করে উপরিভাগের পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে এ সংকট থেকে মুক্তি আসতে পারে।