স্বাদের দিক থেকে আমকে টেক্কা দিতে পারে গরমকালে এমন ফল নেই বললেই চলে। তাই আমকে ফলের রাজা বলা হয়। পাকিস্তান, ভারত, ফিলিপাইনের জাতীয় ফল আম। আর বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ হলো আম গাছ।
বাংলাদেশে আমের জনপ্রিয় জাতগুলো মূলত গ্রীষ্মকালেই পাওয়া যায়, কখনো বর্ষাকালের মাঝামাঝি পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয় ব্যাপ্তি। আম খেতে পছন্দ করেন না এমন বাঙালি পাওয়া দুস্কর। বাজারে বিভিন্ন ধরনের আম রয়েছে। কিন্তু কোনটা কোন জাতের আম, তা চিনতে ও কিনতে বিড়ম্বনার শেষ নেই। অধিকাংশ ক্রেতাই আম চিনতে ভুল করেন। কিনতে গেলেই অনেকের মনে খটকা লাগে, এত আমের মধ্যে কিনবো কোন আম? কোনটা বেশি স্বাদের হবে, মিষ্টি হবে? আবার সন্দেহ জাগে, এগুলো খাঁটি আম তো? “ফল খেলে বল বাড়ে”- সত্য, কিন্তু কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো এসব আম খেলে মনে হয়, এই বুঝি রসাতলে যেতে হবে।
রাজশাহী এক্সপ্রেস পাঠকদেরকে কয়েকটি সেরা জাতের আম চেনার সহজ উপায় জানানোর উদ্দেশ্যেই আমাদের এই আয়োজন। প্রিয় পাঠক, চলুন জেনে নেয়া যাক!
১. গোপালভোগ:
মৌসুমে সবার আগে দেখা যায় গোপালভোগ জাতের আম। গোপালভোগ আম মাঝারি আকারের, পাকা আমের রং হলুদাভ সবুজ, পাকলে খোসা পুরোপুরি হলুদ হয় না, আঁটি পাতলা, আঁশ নেই ও মিষ্টি।
২. হিমসাগর:
উৎকৃষ্ট স্বাদের সুগন্ধযুক্ত জাতের আমের মধ্যে হিমসাগরের অবস্থান প্রায় শীর্ষে। হিমসাগর আম জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে পাকতে শুরু করে এবং পুরো জুন মাস বাজারে পাওয়া যায়। এ আমের ঠোঁট নেই, গড়ন বুকের দিকটা গোলাকার এবং অবতল থেকে সামান্য লম্বাটে আকার নিয়ে শীর্ষদেশ গোলাকৃতির হয়ে থাকে। পরিপক্ক হিমসাগর আমের রং হালকা সবুজ। পাকার পরেও সবুজ থেকে যায়। ত্বক মসৃণ, খোসা পাতলা।
৩. আম্রপালি:
আম্রপালি নিচের দিকে খানিকটা সুঁচালো এবং উপরে একটু গোলাকৃতির হয়। এই আম মিষ্টি বেশি ও স্বাদে অতুলনীয়। আম্রপালি আম মৌসুমের শেষ দিকে পাকে।
৪. ক্ষীরসাপাতি আম:
খুবই মিষ্টি ক্ষীরসাপাতি আম অনেকে হিমসাগর বলে বিক্রি করেন। এই আম আকারে একটু বড় হয়। আমে হালকা দাগ থাকে। ক্ষীরসাপাতি আম বাজারে পাওয়া যায় মে মাসের শেষে অথবা জুনের প্রথম দিকে।
৫. ল্যাংড়া:
ল্যাংড়া আম অনেকটা আয়তাকার গোল, হালকা সবুজ রঙের খোসা। এর নাক নিচের দিকে থাকে। খোসা খুবই পাতলা। ল্যাংড়া আম পাকলেও হলুদ হয় না, খোসা পাতলা, হলুদ শাঁস, ভালোভাবে না পাকলে আম খেলে মুখ চুলকাতে পারে। সুঘ্রাণের সুখ্যাতি রয়েছে ল্যাংড়া আমের।
৬. রাণী পছন্দ:
রাণী পছন্দ দেখতে অনেকটা গোপালভোগের মতোই। এর গায়েও হলুদ দাগ আছে কিন্তু আকারে ছোট। ফলে গোপালভোগের সঙ্গে রাণী পছন্দ মেশালে আলাদা করা কষ্টকর।
৭. বারি আম-২ বা লক্ষণভোগ:
বারি আম-২ বা লক্ষণভোগ চেনার সহজ উপায় হলো এর নাক আছে মাঝামাঝি স্থানে। মিষ্টি তুৃলনামূলক কম ও পাকলে হলুদ রং হয়। সাধারণত জুন মাসের শুরুর দিকে এই আম পাওয়া যায়।
৮. ফজলী ও আশ্বিনা:
আশ্বিনা আর ফজলী আম দেখতে একই রকম। তবে আশ্বিনা আম একটু বেশি সবুজ ও ফজলী আম খানিকটা হলুদ হয়। আশ্বিনার পেট মোটা হয় ও ফজলী দেখতে লম্বা ধরনের হয়।
৯. হাড়িভাঙ্গা:
রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার বিখ্যাত ও সুস্বাদু আম হাড়িভাঙ্গা। এ আমের উপরিভাগ তুলনামূলক বেশি মোটা ও চওড়া এবং নিচের অংশ অপেক্ষকৃত চিকন। আকারে বড় হওয়ার কারেণ ৩টি আমে ১ কেজি হয়ে যায়। এ আম মাংসালো, শ্বাস গোলাকার ও একটু লম্বা। চামড়া কুঁচকে যায় কিন্তু পঁচে না।
১০. মিয়াজাকি বা সূর্যডিম:
দেশীয় এমন বৈচিত্র্যময় জাতের আমের ভিড়ে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে জাপানের বিশেষ প্রজাতির ‘মিয়াজাকি আম’। বাংলাদেশে এটি ‘সূর্যডিম’ নামে স্বল্প পরিসরে পরিচিত। প্রতি কেজি এক হাজার টাকা দাম এই আমের! মিয়াজাকি আমের মিষ্টতা সাধারণ আমের চেয়ে প্রায় ১৫ গুণ বেশি। এতে আঁশ নেই একদমই। একেকটি আমের ওজন হয় ২৫০ থেকে ৩০০ গ্রাম। সূর্যাস্তের সময় পশ্চিমের আকাশ যে রক্তবর্ণ ধারণ করে, তার সঙ্গে মিলিয়েই একে ‘এগ অব দ্য সান’ বলা হয়। আর তার সঙ্গে মিলিয়েই বাংলায় একে বলা হয় ‘সূর্যডিম’। নিঃসন্দেহে এটি আমাদের জন্য বাণিজ্যিক সম্ভাবনাময় একটি ফল।
এছাড়া আগাম জাত হিসেবে রয়েছে বিভিন্ন জাতের আঁটির আম। এখন নাবি জাতের আম হিসেবে বারি আম-৪ ও গৌড়মতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ দুটি জাতের আমই সুমিষ্ট ও সুন্দর চেহারার। বছরে তিনবার ধরে, এমন জাত হিসেবে বারি আম-১১ ও থাইল্যান্ডের কাটিমন জাত চাষের প্রতি অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। পাকা কাটিমন হলুদ সুঘ্রাণযুক্ত মিষ্টি। ব্রুনাই কিং আম লম্বাটে, মুখের দিকটা সরু, একটা আমের ওজন তিন-চার কেজি। ফজলি আমও বড়, একটা আমের ওজন এক থেকে দেড় কেজি হয়।
প্রিয় রাজশাহী এক্সপ্রেস পাঠক, বাইরে থেকে কোনটা কেমিক্যালযুক্ত আম সেটা বোঝা কঠিন। তবে আমরা যদি কোন মৌসুমে কোন আম পাওয়া যাবে এ বিষয়ে সঠিক ধারণা রাখি এবং রাসায়নিক দেয়া আম কেনা থেকে বিরত থাকি, তাহলে অনেকাংশেই অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতারণা থেকে বাঁচা সম্ভব।
মূলত দেশে মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এ পাঁচ মাসকে আমের মৌসুম হিসেবে গণ্য করা হয়। সবচেয়ে বেশি আম পাওয়া যায় জুন থেকে জুলাই মাসে। তবে কোন আমটি কোন সময় পাওয়া যাবে সে বিষয়ে আমাদের অনেকেরই সঠিক ধারণা নেই।
বাংলাদেশের আমের মৌসুমকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায় । আগাম জাত, মধ্য মৌসুমি জাত এবং নাবি জাত। মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস আমের মৌসুম থাকে। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জুনের মাঝামাঝি সময়ে পাকে আগাম জাতের আম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- গোপালভোগ, গোবিন্দভোগ, গুলাবখাশ, রাণীপছন্দ, হিমসাগর, বারি-১ ও ক্ষীরশাপাত।
জুনের মাঝামাঝি থেকে পাকতে শুরু করে মধ্য মৌসুমি আম। এগুলো হলো- ল্যাংড়া, হাঁড়িভাঙ্গা, লক্ষণভোগ, বারি-২ ইত্যাদি।
জুলাই মাস থেকে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পাকে নাবি জাতের আম। সেগুলো হল ফজলি, আম্রপালি, মোহনভোগ, আশ্বিনা, গৌড়মতি, বারি-৩, বারি-৪, ইত্যাদি।
যেসব আম রাসায়নিক বা কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো হয়, সেসব আমের রং বদলে যায়, হরমোনের প্রভাবে খোসায় চমৎকার আকর্ষণীয় রং তৈরি হয়। সেসব টসটসে রং দেখে সহজে মন ভোলে, কিন্তু সেসব আমে প্রকৃত স্বাদ খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই যে জাতের পাকা আমের স্বাভাবিক যে রং হওয়া উচিত, তা দেখে আম কেনা উচিত। এ জন্য কিছুটা অভিজ্ঞতা থাকলে ভালো হয়। অভিজ্ঞতা না থাকলে পরিচিত লোকজনের সাহায্যে কুরিয়ারের মাধ্যমে আমের বাগান থেকে সরাসরি আম সংগ্রহ করা যায়।
জেনে অবাক হবেন, এক কাপ আমে থাকে ৬০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি। যুক্তরাজ্যে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস-এর প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯ থেকে ৬৪ বছরের পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ৪০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি প্রয়োজন। আমে রয়েছে ২০ টি ভিন্ন ভিন্ন ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ, যার মধ্যে অধিক পরিমাণে ভিটামিন এ, পটাশিয়াম এবং ভিটামিন বি-এর একটি উপাদান ফোলাইট থাকে। আমে আছে প্রচুর আঁশ। তাই চিকিৎসকের বিধিনিষেধ না থাকলে খাঁটি আম খেতে পারেন নির্দ্বিধায়!