ফলের রাজা আম। রং, আকার, স্বাদ, পুষ্টি আর ঘ্রাণে আমের জুড়ি মেলা ভার। বাংলাদেশের মাটি, আবহাওয়া, জলবায়ু সব কিছুই আম চাষের উপযোগী হওয়ায় দেশের নানা প্রান্তে কম বেশি আমের চাষ হয়। তবে রাজশাহী অঞ্চলের (বিশেষত রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলা) আম জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কিন্তু কেন? প্রিয় রাজশাহী এক্সপ্রেস পাঠক, চলুন জেনে নেয়া যাক রাজশাহী অঞ্চলের আমের জনপ্রিয়তার কয়েকটি কারণ।
১। ভৌগোলিক উপাদান:
রাজশাহী অঞ্চলের ভৌগোলিক উপাদান দেশের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে পৃথক। ভৌগোলিক উপাদান বলতে তাপমাত্রা, বায়ুমণ্ডল, বৃষ্টিপাত প্রভৃতি বোঝানো হয়। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মোট ১১ জেলায় ৭ লাখ হেক্টর জমিজুড়ে রয়েছে বরেন্দ্র এলাকা। যার মধ্যে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং নওগাঁ জেলায় ১,৬০,০০০ হেক্টর জমি উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চল। আর এই অঞ্চলেই সিংহভাগ আম উৎপন্ন হয়। আমের মুকুল গঠনের সময় কিছুদিন একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় থাকলে বিশেষ কুড়ি রুপান্তরিত হয় ফুলে। নয়তো সেটি নতুন পাতায় রূপান্তরিত হয়। প্রায় প্রতি বছর আমের মুকুল হবার মৌসুমে রাজশাহী অঞ্চলের তাপমাত্রা অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আমের জন্য অনুকূলে থাকে। ফলে গাছে বেশি মুকুল আসে। আর মুকুল বেশি মানেই আমের ফলন বেশি।
২। মাটির গুণাগুণ:
বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশ কম। গবেষকগণ পরীক্ষা করে দেখেছেন এ অঞ্চলের মাটিতে শতকরা ০.৮ থেকে ১.৫ ভাগ জৈব পদার্থ রয়েছে। মাটি খানিকটা অম্লধর্মী যার পিএইচ ৫.২-৬.২। আমের উৎপাদন ও স্বাদে প্রভাব ফেলে মাটির গুণাগুণ। ঠিক সে কারণেই রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, রংপুর, সাতক্ষীরা অঞ্চলে আম উৎপাদন বেশি হয় এবং এসব অঞ্চলের আমের স্বাদেও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।
৩। বিভিন্ন জাত:
নানা প্রকার গুটি (আগাম জাত), গোপালভোগ, লক্ষ্মণভোগ বা লখনা, রানিপছন্দ, হিমসাগর বা ক্ষীরশাপাতি, ল্যাংড়া, ফজলি, আম্রপালি, আশ্বিনা, বারি আম-৪, গৌড়মতি, ইলামতি, কাটিমন, বারি আম-১১ সহ অসংখ্য জাতের নানা বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদের আম রাজশাহী অঞ্চলে পাওয়া যায়। বৈচিত্র্যময় জাতের প্রাচুর্যের কারণে এই অঞ্চলের আম এত জনপ্রিয় বলে মনে করা হয়।রাজশাহী অঞ্চলে উৎপাদিত বিভিন্ন জাতের আম কোন সময় থেকে বিক্রির জন্য পাড়া শুরু করা যাবে তার সময় সীমা উল্লেখ করে প্রতিবছর একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। স্থানীয়ভাবে যেটিকে বলা হয় ‘ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার’। ২০১৭ সাল থেকে রাজশাহী জেলায় ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার প্রকাশিত হয়ে আসছে।
৪। আম চাষ পদ্ধতি:
কিছুটা অম্লীয় মাটিতে উঁচু ও সুনিষ্কাশিত স্থান নির্বাচন, জমি তৈরি, উপযুক্ত সময়ে চারা রোপণ প্রণালী, পরিমাণমতো সার ও সেচ দেয়া, আগাছা দমন, অপ্রয়োজনীয় ডাল-পাতা ছাঁটাই, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে গাছের মুকুল ভাঙ্গন, রোগ ও পোকা দমন ব্যবস্থাপনা সর্বোপরি অনন্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজশাহী অঞ্চলে আম চাষ হয়। যে কারণে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে এই অঞ্চলের আম।
৫। আম সংগ্রহ ও মোড়কজাতকরণ:
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অত্যন্ত যত্নের সাথে রাজশাহী অঞ্চলের আম চাষীগণ আম সংগ্রহ করে থাকেন। আম গাছ হতে দুইভাবে পাড়া হয়; হাত দিয়ে এবং সংগ্রাহক (স্থানীয় ভাষায় ‘লগি’ বা ‘লগা’ ও ঠুসি) ব্যবহার করে। গাছ ছোটো হলে হাত দিয়েই পাড়া হয় আর বড় হলে পাতলা বাঁশের তৈরি আম সংগ্রাহক বা ঠুসি ব্যবহার করা হয়। সাধারণত গাছ থেকে আম সংগ্রহ করা হয় মেঘমুক্ত, রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে এবং সকাল বেলায়। গাছ থেকে পাড়ার পর আমকে কিছুক্ষণ উপুড় করে রাখা হয়, যাতে আঠা ঠিকমতো ঝরে পড়ে ও আমের গায়ে না লাগে। অনেক সময় বাজারজাতকরণের সুবিধার্থে বারে বারে আম পাড়া হয়। পাড়ার পর আঘাতপ্রাপ্ত, রোগাক্রান্ত, পোকা দ্বারা আক্রান্ত, পাখিতে খাওয়া ও গাছ পাকা আম পৃথক করে রাখা হয়। এরপর প্যাকিং এর পালা। একসময় প্যাকিংয়ে বাঁশের ঝুড়ি ব্যবহার করা হতো। এখন প্লাস্টিকের ক্রেটসে (স্থানীয় নাম ‘ক্যারেট’) আম পরিবহণ করা হয়। খবরের কাগজ বা নরম খড় দিয়ে স্তরে স্তরে সাজানো হয় ক্রেটস। পরিশেষে নানা মাধ্যমে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো হয় রাজশাহীর বিখ্যাত আম!
প্রিয় পাঠক, রাজশাহীর আম এখন ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী। পৃথিবীর নানা দেশে রপ্তানি হচ্ছে এই অঞ্চলের আম। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, আগে প্রতি মৌসুমে গড়ে আমের ব্যবসা ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। গত বছর এক হাজার কোটি টাকার মতো আমের বাণিজ্য হয়, যা এবার দেড় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে এমনই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।