রাজশাহী শহর হতে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার পূর্বে এবং রাজশাহী-নাটোর মহাসড়ক হতে মাত্র এক কিলোমিটার দক্ষিণে, রাজশাহী জেলার অন্যতম উপজেলা পুঠিয়াতে এই পুঠিয়া রাজবাড়ী অবস্থিত যা পাঁচআনি জমিদারবাড়ী নামেও পরিচিত।
মুঘল সম্রাট আকবর এর সময়কালে পুঠিয়া রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। জনৈক পীতম্বর নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যু বরণকরলে তার সহোদর নীলাম্বর জমিদারী প্রাপ্ত হন। নীলাম্বর মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের থেকে ‘রাজা’ উপাধি লাভ করার পর সেটি পুঠিয়া রাজবাড়ীরূপে পরিচিতি লাভ করে। নীলাম্বর এর মুত্যুর পর পুত্র আনন্দরাম সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। আনন্দরাম এর একমাত্র পুত্র রতিকান্তের জ্যেষ্ঠ পুত্র রামচন্দ্র সকল সম্পত্তির মালিক হন। রামচন্দ্রের দ্বিতীয় পুত্র নরনারায়নের পর তার একমাত্র পুত্র প্রেমনারায়ন রাজ্যাধিকার পান।
পরবর্তীতে ১৭৪৪ সালে জমিদারি ভাগ হয়। সেই ভাগাভাগিতে জমিদারের বড় ছেলে পান সম্পত্তির সাড়ে পাঁচ আনা এবং অন্য তিন ছেলে পান সাড়ে তিন আনা। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত জমিদারি প্রথা ছিল। প্রথা বিলুপ্ত হলে পুঠিয়া রাজবাড়ীর জমিদারিও বিলুপ্ত হয়। কিন্তু জমিদারি বিলুপ্ত হলেও সে আমলে নির্মিত তাদের প্রাসাদ, মন্দির ও অন্যান্য স্থাপনা ঠিকই এখনো টিকে রয়েছে।
মহারানী হেমন্তকুমারী দেবীর এই বাসভবন অর্থাৎ পুঠিয়া রাজবাড়ী বাংলাদেশে বিদ্যমান অন্যান্য রাজবাড়িগুলোর চেয়ে মাধুর্য স্থাপত্যে সজ্জিত। সম্মুখভাগের অলংকরণ, কাঠের কাজ, কক্ষের দেয়াল-দরজায় ফুল ও লতাপাতার চিত্রকর্ম যথাযথ নির্মাণের পরিচয় বহন করা দ্বিতল রাজবাড়ীটি ইন্দো ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতিতে ১৮৯৫ সালে মহারানী হেমন্তকুমারী দেবী তার শাশুড়ি মহারানী শরৎ সুন্দরী দেবীর সম্মানে নির্মাণ করান। যার ছাদে ব্যবহৃত হয়েছে লোহার বীম, কাঠের বর্গা এবং টালি। আর নিরাপত্তার জন্য রাজবাড়ির চারপাশে করা হয়েছিল ছোট ছোট দিঘী। দিঘীগুলো বর্তমানে বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন – শিবসাগর, গোপালচৌকি, বেকিচৌকি, গোবিন্দ সরোবর, মরাচৌকি। এছাড়াও শ্যামসাগর নামে একটি বিশাল পুকুর রয়েছে রাজবাড়ি সীমানার মধ্যস্থলে।
সেসময় জমিদারগণ তাদের প্রশাসনিক কাজকর্ম ও ধর্মীয় কার্যাদি সম্পন্নের জন্য বিভিন্ন স্থাপত্য কাঠামো ও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মন্দির নির্মাণ করেন, যা আজও কালের সাক্ষী হিসাবে টিকে আছে। প্রতিটি মন্দিরের দেয়ালেই রয়েছে অপূর্ব সব পোড়ামাটির ফলকের কারুকাজ। উল্লেখ্য পুঠিয়ার প্রত্ননিদর্শনের মধ্যে ১৪টি স্থাপনা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসাবে ঘোষনা করেছে। নিচে উল্লেখযোগ্য কিছু মন্দির নিয়ে সংক্ষেপে লেখা হলো –
বড় আহ্নিক মন্দির – উত্তর দক্ষিণে লম্বা আয়তাকার পাশাপাশি ৩টি কক্ষ আছে এ মন্দিরে। মাঝের কক্ষের পূর্বদিকে রয়েছে তিনটি খিলান প্রবেশ পথ এবং উপরে দোচালা আকৃতির ছাদ আছে। মন্দিরটির সম্মুখের দেয়ালে অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক রয়েছে।
বড় শিব মন্দির – পুঠিয়া বাজারে প্রবেশ করতেই দেখা মিলবে বড় শিব মন্দির যা শিবসাগর নামক দীঘির পাড়ে অবস্থিত। উচু মঞ্চের উপর নির্মিত মন্দিরটির দক্ষিণ দিকে সুপ্রশস্ত সিড়িসহ প্রধান প্রবেশপথ। মন্দিরের চারপাশের বারান্দায় রয়েছে ৫টি করে খিলান প্রবেশপথ। এছাড়াও মন্দিরের উত্তর পাশে অবস্থিত দীঘিতে নামার জন্য রয়েছে বাঁধানো ঘাট। ১৮২৩ সালে নারী ভূবনময়ী দেবী এ মন্দিরটি নির্মাণ করেন।
দোল মন্দির – ইষ্ট চুন ও সুড়কীর তৈরী দোল মঞ্চ মন্দিরটি পুঠিয়া রাজবাড়ীর সম্মুখস্থলে অবস্থিত। ক্রমশ ছোট থাকে থাকে উপরে উঠে যাওয়া চারতলা বিশিষ্ট মন্দিরের প্রত্যেক বাহুর পরিমাপ ২১.৫৪ মিটার। এর প্রত্যেক তলের প্রত্যেক বাহুতে রয়েছে অসংখ্য প্রবেশ পথ। চতুর্থ তলের উপরে আছে মন্দিরের গমবুজ আকৃতির চূড়া। চূড়ার শীর্ষদেশে ফিনিয়েল দ্বারা শোভিত। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে পুঠিয়ার পাঁচআনী জমিদার বাড়ীর হেমন্ত কুমারী দেবী কর্তৃক নির্মিত এ মন্দিরের উচ্চতা সমতল ভূমি থেকে ২০ মিটার।
গোবিন্দ মন্দির – একটি উচু বেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত জমিদার বাড়ি অঙ্গনে অবস্থিত গোবিন্দ মন্দির একটি গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি। বর্গাকার নির্মিত এ মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে আছে একটি কক্ষ ও চার কর্ণারে রয়েছে ৪টি বর্গাকৃতির ছোট কক্ষ। রয়েছে ৪টি খিলান প্রবেশ পথ। এই মন্দিরের পিলার ও দেয়াল অসংখ্য দেব-দেবী, যুদ্ধের সাজসজ্জা, ফুল ইত্যাদির পোড়ামাটির ফলক দ্বারা সজ্জিত। প্রেম নারায়ণ রায় আঠার খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে সামান্য কার্ণিশ বাকানো এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন।
গোপাল মন্দির – চার আনি মন্দির চত্ত্বরের উত্তর পাশে অবস্থিত এ মন্দিরে মোট ৫টি প্রবেশপথ আছে। দক্ষিণমুখী এ মন্দিরের উত্তর দিক ব্যতিত অপর তিন দিকে বারান্দা আছে। এছাড়াও মন্দিরের দ্বিতীয় তলায় উঠার জন্য পশ্চিম দিকে ১টি সিড়ি আছে।
যেভাবে যাবেন –
রাজশাহী শহরের ভদ্রা কিংবা তালাইমারি থেকে সরাসরি পুঠিয়ার বাস পাওয়া যায়। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৪০-৫০ টাকা। বাস থেকে পুঠিয়ায় নেমে রাজবাড়ী যাওয়ার জন্য পাওয়া যাবে অসংখ্য ভ্যান। ভাড়া নিবে জনপ্রতি ১০ টাকা। বাসে যেতে না চাইলে অটো বা সিএনজি করে রাজশাহী শহর থেকে প্রথমে বানেশ্বর বাজার পর্যন্ত যেতে হবে, এক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৩০-৪০ টাকা। বানেশ্বর বাজার থেকে আবার পুঠিয়া যাওয়ার জন্য পাওয়া যাবে অটো বা সিএনজি, ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ২০-২৫ টাকা। এছাড়াও ব্যাক্তিগত গাড়ি নিয়ে খুব সহজেই চলে যেতে পারবেন আর গাড়ি পার্কিং করার জন্য পাবেন রাজবাড়ীর সুবিশাল মাঠ।
নাইমুর রহমান
শিক্ষার্থী
জার্নালিজম,
কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ
বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়