রাজশাহী জেলা বাংলাদেশের উত্তর– পশ্চিমাঞ্চলের একটি অন্যতম সুন্দর জেলা। বাংলাদেশের পুরাতন জেলাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জেলা হিসেবে দেশব্যাপী বিখ্যাত রাজশাহী। আমের রাজ্য, রেশমের নগরী হিসেবেও রাজশাহী সমধিক পরিচিত।
রাজশাহী জেলার সীমান্তে নওগাঁ জেলা, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, কুষ্টিয়া জেলা ও পদ্মা নদী অবস্থিত। এটির মোট আয়তন ২৪০৭.০১ বর্গকিলোমিটার। রাজশাহী প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন জনপদের অংশ এবং হাজার বছরের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। “রাজশাহী” শব্দটি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই এটি দুটি ভিন্ন ভাষার শব্দের সংযোগ হয়ে তৈরি হয়েছে। সংস্কৃত ভাষায় “রাজ” অর্থ ‘রাজা’ বা ‘রাজকীয়’, এবং ফারসি ভাষায় “শাহ” অর্থ ‘বাদশাহ’। এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে “রাজশাহী” নামটি উদ্ভাবিত হয়েছে, এর অর্থ হল ‘রাজা বা বাদশাহের শহর’। তবে ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়ের মত অনুযায়ী, “রাজশাহী” নামটি রাণী ভবানীর দেয়া। মি. গ্রান্ট এর মতে রাজশাহী নামটি রাণী ভবানীর জমিদারীকে বোঝাতো এবং এই নামটি চলে এসেছিলো চাকলার বন্দোবস্তের সময়।
পাঠক, চলুন জেনে নিই রাজশাহী জেলার উপজেলা সম্পর্কে –
পবা উপজেলা
পবা উপজেলা রাজশাহী জেলায় অবস্থিত একটি উপজেলা। এই উপজেলাটিতে ৮টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভা রয়েছে, যেখানে “বড়গাছী ইউনিয়ন” অন্যতম। এর আয়তন ২৮০.৪২০ বর্গ কিলোমিটার।
উপজেলা হওয়ার পূর্বে পবা মৌজায় পবা থানা অবস্থিত ছিল, কিন্তু ১৯৮৩ সালের ১১ নভেম্বরে এটি উন্নীত হয়ে পবা উপজেলা হিসাবে গঠিত হয়।
পবা উপজেলায় বেশ কয়েকটি মেট্রোপলিটন থানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং পবা থানার নামকরণ করা হয় শাহমখদুম থানা। এখানে একটি বিমান বন্দর, একটি সুগার মিল, একটি জুটমিল, একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, আটটি বৃহৎ কোল্ড স্টোরেজ (যার মধ্যে অন্যতম মাধবপুরে অবস্থিত “রাজ কোল্ড স্টোরেজ”) যেটি বর্তমান এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় আলুর কোল্ড স্টোরেজ। ২০১৯ সালে পবা থানাটি রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের অধীনে আনা হয়েছে।
চারঘাট উপজেলা
চারঘাট বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। চারঘাট উপজেলায় মোট ৬টি ইউনিয়ন রয়েছে। এই উপজেলার উত্তরে পুঠিয়া উপজেলা, দক্ষিণে বাঘা উপজেলা, পূর্বে নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলা এবং পশ্চিমে পবা উপজেলা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে অবস্থিত। এর পাশে পদ্মা নদী প্রবাহিত। চারঘাট উপজেলার অর্থনীতির প্রধান আয়ের উৎস হল কৃষি।
এখানে অনেকে চাষাবাদ এবং কৃষিনির্ভর ব্যবসা করেন। তবে কিছু লোক ব্যবসায়ী, জেলে ও তাঁত শিল্পের সাথে জড়িত। চারঘাট উপজেলা আম উৎপাদন ও বিপণনে প্রসিদ্ধ। এই উপজেলা খয়ের শিল্পের জন্য বেশি বিখ্যাত। চারঘাট উপজেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি এখানকার বিশেষ আকর্ষণ। এখানে পুলিশ একাডেমি, ক্যাডেট কলেজ অবস্থিত।
বাঘা উপজেলা
বাঘা রাজশাহী জেলার একটি উপজেলা যা বাংলাদেশে অবস্থিত। এই উপজেলার অন্তর্ভুক্ত পৌরসভা সংখ্যা ০২, ইউনিয়ন সংখ্যা ৭, মৌজা সংখ্যা ৯৯ এবং গ্রাম সংখ্যা ১২৬। এর আয়তন ১৮৪.২৫ বর্গ কিলোমিটার। উত্তরে চারঘাট ও বাগাতিপাড়া উপজেলা, দক্ষিণে দৌলতপুর উপজেলা (কুষ্টিয়া), পূর্বে লালপুর ও বাগাতিপাড়া উপজেলা, পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং পদ্মা (গঙ্গা) নদী। এই উপজেলায় অনেকগুলো প্রসিদ্ধ বাজার এবং ২টি গরুর হাট রয়েছে। এখানে প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদগুলোর মধ্যে রয়েছে দশ গম্বুজ বিশিষ্ট বাঘা শাহী মসজিদ ও দীঘি (১৫২৩), মীরগঞ্জের নীলকুঠি (বর্তমানে রেশম শিল্পের কারখানা), দিলাল বোখারীর (রহ.) মাযার (আলাইপুর)। বাঘা উপজেলায় প্রচুর পরিমাণে আম উৎপাদিত হয়।
পুঠিয়া উপজেলা
রাজশাহী শহর হতে পুঠিয়ায় দূরত্ব মাত্র ৩২ কিলোমিটার এবং নাটোর হতে দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। এই উপজেলার বর্তমান আয়তন ১৯২.৬৪ বর্গকিলোমিটার।
এর উত্তরে দুর্গাপুর (রাজশাহী) ও বাগমারা উপজেলা, দক্ষিণে চারঘাট ও বাগাতিপাড়া উপজেলা, পূর্বে নাটোর সদর উপজেলা, পশ্চিমে দুর্গাপুর ও পবা উপজেলা। পুঠিয়া থানা গঠিত হয় ১২ মার্চ ১৮৬৯ সালে এবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৪ সালে।
এখানে প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদগুলোর মধ্যে রয়েছে সৈয়দ করম আলী শাহের (রঃ) বিরাট মসজিদ ও মাযার, পুঠিয়ার রাজবাড়ি, রাজবাড়িতে ঝুলন মন্দির, আহ্নিক মন্দির (ছোট আহ্নিক মন্দির ও বড় আহ্নিক মন্দির, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে বা ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমে নির্মিত), চৌচালা (পিরামিডাকৃতির) মন্দির (ছোট গোবিন্দমন্দির ও ছোট শিবমন্দির, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে বা ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমে নির্মিত), রত্নমন্দির (একরত্ন বা প্রাণগোপাল মন্দির ঊনবিংশ শতকে নির্মিত, পঞ্চরত্ন মন্দির নির্মিত ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে এবং পঞ্চরত্ন শিবমন্দির প্রতিষ্ঠিত ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে), সমতল ছাদবিশিষ্ট দালান মন্দির (গোপাল মন্দির ও তারাপুর মন্দির), অষ্টকোণা মন্দির বা রথ মন্দির, দোচালা বা একবাংলা মন্দির (ঊনবিংশ শতকে নির্মিত), দোলমন্দির বা দোলমঞ্চ (১৮৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত) এবং শিবসাগর ও গোবিন্দসাগর নামে দু’টি বড় দীঘি। দেশের অন্যতম বৃহৎ আমের হাট পুঠিয়ার বানেশ্বরে।
তানোর উপজেলা
তানোর উপজেলা হলো রাজশাহী জেলার একটি উপজেলা। এই উপজেলার থানা গঠন করা হয়েছিল ১৮৬৯ সালে এবং উপজেলাটি গঠিত হয় ১৯৮৩ সালে। এর আয়তন ২৯৫.৩৯ বর্গ কিলোমিটার। তানোরের উত্তরে নাচোল ও নিয়ামতপুর উপজেলা, দক্ষিণে পবা ও গোদাগাড়ী উপজেলা, পূর্বে মোহনপুর ও মান্দা উপজেলা, পশ্চিমে নাচোল, নবাবগঞ্জ সদর ও গোদাগাড়ী উপজেলা।
পুরাকালে এই অঞ্চলে জনপদ বলতে তেমন কিছুই ছিল না। কিন্তু আজকে এই জনপদ তানোর একটি শস্যশ্যামল খাদ্য ভান্ডার হিসাবে পরিণত হয়েছে। এখানে অনেকগুলো আদিবাসী গ্রাম রয়েছে এবং তারা এখানে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করে। এখানে প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদগুলোর মধ্যে রয়েছে সিধইর গ্রামে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট ভাগনা জামে মসজিদ (১২২৩ হিজরি), মুন্ডুমালা গ্রামে প্রাচীন মসজিদ (ষোড়শ শতক), তালন্দ শিব মন্দির (১৮৬০) ও দুর্গা মন্দির এবং বিহারোল গ্রামে বৌদ্ধ বিহার।
মোহনপুর উপজেলা
মোহনপুর বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার একটি উপজেলা। এই উপজেলাটি ১৯১৭ সালে থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। পরবর্তীতে এ থানা ১৯৮৩ সালে উপজেলাভুক্ত হয়। এর আয়তন ১৬২.৬৫ বর্গ কিলোমিটার। এর উত্তরে মান্দা ও তানোর উপজেলা, দক্ষিণে পবা ও দুর্গাপুর (রাজশাহী) উপজেলা, পূর্বে বাগমারা উপজেলা এবং পশ্চিমে তানোর উপজেলা।
এখানে প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদের মধ্যে রয়েছে বিশালপুর প্রাচীন মন্দির। মোহনপুর এলাকায় ঋতু অনুযায়ী অনেক ফসল উৎপাদন হয়। পানবর্জ হচ্ছে এলাকার অর্থনীতির প্রধান উৎপাদন। মোহনপুর উপজেলায় সবচেয়ে বড় পান হাট আছে যা নিম্নলিখিত এলাকাগুলোতে অবস্থিতঃ
- পাকুড়িয়া
- মৌগাছি
- ধোপাঘাটা
- কুঠিবাড়ি
- একদিল, তলা
দুর্গাপুর উপজেলা
দুর্গাপুর বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার একটি উপজেলা। দুর্গাপুর উপজেলাটি ৭টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে, যার আয়তন ১৯৫.০৩ বর্গ কিলোমিটার। দুর্গাপুর উপজেলার উত্তরে বাগমারা এবং মোহনপুর উপজেলা, দক্ষিণ ও পূর্বে পুঠিয়া উপজেলা, পশ্চিমে পবা উপজেলা অবস্থিত।
এখানে প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদগুলোর মধ্যে রয়েছে কিসমত মসজিদ (মাড়িয়া, অষ্টাদশ শতাব্দী), রুইপাড়া জামে মসজিদ (ষোড়শ শতাব্দী), পাঁচুবাড়ী পাঁচগম্বুজ জামে মসজিদ, কালী মন্দির (কালীদহ), নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ (পাননগর ও বখতিয়ারপুর)। দুর্গাপুর একটি কৃষি-প্রধান এলাকা। ধান, পান, আলু, গম, ভুট্টা প্রধান ফসল। এছাড়াও এই উপজেলাটি মাছ চাষের জন্য পরিচিত।
বাগমারা উপজেলা
রাজশাহী জেলার আরেকটি বড় উপজেলা হলো বাগমারা। এই উপজেলাটিতে ৭টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা রয়েছে, এর আয়তন ৩৬৩.৩ বর্গ কিলোমিটার। বাগমারা উপজেলার উত্তরে মান্দা ও আত্রাই উপজেলা, দক্ষিণে দুর্গাপুর, পুঠিয়া এবং নাটোর সদর উপজেলা, পূর্বে আত্রাই এবং নাটোর সদর উপজেলা, পশ্চিমে মোহনপুর উপজেলা অবস্থিত।
এখানে প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদগুলোর মধ্যে রয়েছে বারনাই নদীর তীরে অচিন ঘাট গ্রামে পাঁচপীরের মাজার ও শাহী মসজিদ। এই উপজেলার প্রধান কৃষি ফসলগুলো হলো ধান, গম, আলু, ভুট্টা, সরিষা, তিল, পান, শাকসবজি।
গোদাগাড়ী উপজেলা
গোদাগাড়ী রাজশাহী জেলার একটি উপজেলা। ১৮৬৫ সালে গোদাগাড়ী থানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮৪ সালে এটি উপজেলা হিসেবে গঠিত হয়। এখানে ৯টি ইউনিয়ন, ৩৮৯টি মৌজা এবং ৩৯৬টি গ্রাম রয়েছে। এর আয়তন ৪৭২.১৩ বর্গ কিলোমিটার। গোদাগাড়ী উপজেলার উত্তরে নবাবগঞ্জ সদর ও তানোর উপজেলা, দক্ষিণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও গঙ্গা নদী, পূর্বে পবা ও তানোর উপজেলা, পশ্চিমে নবাবগঞ্জ সদর উপজেলা অবস্থিত।
এখানে প্রাচীন নিদর্শনাদি ও প্রত্নসম্পদগুলোর মধ্যে রয়েছে উপরবাড়ি টিলা বৌদ্ধ বিহার (পাল আমল), কুমারপুরের আলী কুলীবেগের মাজার (অষ্টম শতাব্দী), দেওপাড়া গ্রামে পদুমসার শিব মন্দির, দীঘি ও প্রশস্তি শিলালিপি (একাদশ শতাব্দীতে রাজা বিজয় সেন নির্মাণ করেন), হযরত শাহ সুলতানের মাযার (চতুর্দশ শতাব্দী, সুলতানগঞ্জ), এবং খেতুর গ্রামের শ্রী শ্রী গৌরাঙ্গবাড়ী মন্দির (১৫৮২) ও মান্ডইলের জৈন মন্দির। এটি কৃষি প্রধান এলাকা। ধান, গম, আলু এবং অন্যান্য ফসল এখানে চাষ করা হয়।
১ কমেন্ট
জেনে খুব ভালো লাগলো। ধন্যবাদ!
তবে বাগমারাতে ১৬টি ইউনিয়ন এবং ২টি পৌরসভা রয়েছে।
যা লিখেছেন ৭টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা।