প্রমত্তা পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী মহানগরী এবং উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় শহর হলো রাজশাহী। শহরের পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর দিক আম্রকানন দিয়ে পরিবেষ্টিত। এখানকার জনগোষ্ঠীর প্রধান পেশা কৃষি। বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন বিভাগীয় এই শহরটি। এমনকি বাংলাদেশের শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম বায়ু দূষণের শহরও রাজশাহী।
সিল্ক বা রেশম, আম, লিচু, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং নানা ধরণের মিষ্টান্নসামগ্রীর জন্য রাজশাহী প্রসিদ্ধ। রেশমীবস্ত্রের কারণে রাজশাহীকে রেশম নগরী নামেও ডাকা হয়। এই শহরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের অনেকগুলোর খ্যাতি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। সে কারণে রাজশাহীকে “শিক্ষা নগরী” আখ্যায়িত করা হয়।
রাজশাহী নামকরণের ইতিহাসঃ
‘রাজশাহী’ নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলেই কয়েক শতাব্দী পূর্বে ফিরে যেতে হয়। এ শহরের প্রাচীন নামটি ছিল ‘মহাকাল গড়’। পরে রূপান্তরিত হয়ে দাঁড়ানো রামপুর- বোয়ালিয়া থেকে ‘রাজশাহী’ নামটির উদ্ভব কিভাবে হলো এর সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। ব্রিটিশ আমলের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসেও রাজশাহী নামে কোন জনপদ বা স্থানের উল্লেখ নেই। অনেকে মনে করেন, এই জনপদ একদা বহু হিন্দু, মুসলিম, রাজা, সুলতান আর জমিদার শাসিত ছিল বলে নামকরণ হয়েছে রাজশাহী।
ঐতিহাসিক ব্লকম্যানের (Bolch Mann) মতে, খ্রিষ্টীয় ১৫শ শতকে গৌড়ের মুসলিম সালতানাত এই জেলার ভাতুড়িয়ার জমিদার রাজা গণেশ কতৃর্ক আত্মসাতের সময় থেকে রাজশাহী নামের উদ্ভব হয়েছে। তবে বাংলা ভাষায় আমরা একই অর্থের অনেক শব্দ দুই বার উচ্চারণ করে থাকি। যেমন শাক-সবজি, চালাক-চতুর, ভুল-ভ্রান্তি, ভুল-ত্রুটি, চাষ-আবাদ, ধার-দেনা, শিক্ষা-দীক্ষা, দীন-দুঃখী, ঘষা-মাজা, মান-সম্মান, দান-খয়রাত, পাহাড়-পর্বত, পাকা-পোক্ত, বিপদ-আপদ ইত্যাদি। অদ্ভুত ধরণের এই ‘রাজশাহী’ শব্দের উদ্ভবও যে এভাবে ঘটে থাকতে পারে তা মোটেই উড়িয়ে দেয়া যায় না! ফলে এই নামকরণ নিয়ে অনেক কল্পকাহিনীও রয়েছে।
অনেকের মতে, সংস্কৃত ‘রাজ’ আর ফারসি ‘শাহ’ এই শব্দ দুটির সমন্বয়ে উদ্ভব হয়েছে মিশ্রজাত শব্দটির। অন্যদিকে ব্লকম্যানের অভিমত গ্রহণে আপত্তি করে বেভারিজ (Beveridge) বলেন, নাম হিসেবে রাজশাহী অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন এবং এর অবস্থান ছিল রাজা গণেষের জমিদারী ভাতুড়িয়া পরগনা থেকে অনেক দূরে। রাজা গণেশের সময় এই নামটির উদ্ভব হলে টোডরমল প্রণীত খাজনা আদায়ের তালিকায় অথবা আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী নামক গ্রন্থে সেটার উল্লেখ অবশ্যই পাওয়া যেত। ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের মতে, নাটোরের রাজা রামজীবনের জমিদারী রাজশাহী নামে পরিচিত ছিল এবং সেই নামই ইংরেজরা গ্রহণ করেন এই জেলার জন্য।
বিস্তারিত জানতে:
https://www.rajshahiexpress.com/rajshahi/92286/?fbclid=IwAR1hAT6F9aG4nX99bDdyILg_Nl-p7So-9f-CxNzzOOP7Yt-naBD_ujpDjPE
রাজশাহী বিভাগের ইতিহাসঃ
রাজশাহী বিভাগ বাংলাদেশের উত্তর- পশ্চিমাঞ্চলের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। ১৮,১৫৪ বর্গ কি.মি. আয়তন বিশিষ্ট এই বিভাগ ৮টি জেলা, ৬৬টি উপজেলা এবং ৫৬৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে উত্তরবঙ্গের বিশাল অংশ নিয়ে একটি বিভাগ গঠিত হয়েছিল। সে সময় এর সদর দফতর ছিল ভারতের মুর্শিদাবাদ। ৮টি জেলা নিয়ে এই বিভাগটি গঠিত হয়েছিল। জেলাগুলো ছিলো- মুর্শিদাবাদ, মালদহ, জলপাইগুড়ি, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা ও রাজশাহী। কয়েক বছর পর বিভাগীয় সদর দপ্তর বর্তমান রাজশাহী শহরের রামপুর- বোয়ালিয়া মৌজায় স্থানান্তরিত হয়েছিলো। পরবর্তীতে ১৮৮৮ সালে বিভাগীয় সদর দপ্তর ভারতের জলপাইগুড়িতে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৪৭ সালের পাক-ভারত বিভাজনের পর তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের বিভাগে পরিণত করা হয় রাজশাহীকে। এই বিভাগের সদর দফতর রাজশাহী শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন রাজশাহী বিভাগের জেলাগুলো ছিলো- কুষ্টিয়া, খুলনা, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা, যশোর, রংপুর ও রাজশাহী। ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিভাগের খুলনা, কুষ্টিয়া, যশোর এবং ঢাকা বিভাগের বরিশাল জেলা কর্তন করে খুলনা বিভাগ গঠন করা হয়। ফলে রাজশাহী বিভাগের জেলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ এবং জেলাগুলো ছিলো- দিনাজপুর, পাবনা, বগুড়া, রংপুর ও রাজশাহী। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ৫ টি জেলা নিয়ে রাজশাহী বিভাগ বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৮৪ সালে এই বিভাগের প্রতিটি জেলার ‘মহকুমা’ জেলাতে পরিণত হয়। তখন এই বিভাগের মোট জেলার সংখ্যা ছিল ১৬টি। ২০১০ সালে রংপুর অঞ্চলের ৮টি জেলা নিয়ে রংপুর বিভাগ গঠন করা হয় এবং রাজশাহী অঞ্চলের ৮টি জেলা নিয়ে বর্তমান রাজশাহী বিভাগ পুনর্গঠিত হয়।
রাজশাহী বিভাগে জেলা কয়টি?
বর্তমানে রাজশাহী বিভাগ ৮ টি জেলা নিয়ে গঠিত। জেলাগুলো হলো- নওগাঁ, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, পাবনা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহী।
রাজশাহী জেলার উপজেলা কয়টি?
রাজশাহী জেলায় ৯ টি উপজেলা রয়েছে। সেগুলো হলো-
১। পবা (ইউনিয়ন ৮টি)
২। চারঘাট (ইউনিয়ন ৬টি)
৩। বাঘা (ইউনিয়ন ৬টি)
৪। পুঠিয়া (ইউনিয়ন ৬টি)
৫। তানোর (ইউনিয়ন ৭টি)
৬। মোহনপুর (ইউনিয়ন ৬টি)
৭। দূর্গাপুর (ইউনিয়ন ৭টি)
৮। বাগমারা (ইউনিয়ন ১৬টি)
৯। গোদাগাড়ী (ইউনিয়ন ৯টি)
রাজশাহী জেলার সবচেয়ে বড় উপজেলা কোনটি?
রাজশাহী জেলার সবচেয়ে বড় উপজেলা হলো বাগমারা।
রাজশাহী জেলার থানা কয়টি?
রাজশাহী জেলায় ১৩ টি থানা রয়েছে। থানাগুলো হলো: পবা, গোদাগাড়ী মডেল, মোহনপুর, বাগমারা, চারঘাট মডেল, পুঠিয়া, দুর্গাপুর, বাঘা, তানোর, বোয়ালিয়া, রাজপাড়া, শাহমখদুম ও মতিহার।
আরএমপি’র অধীনে কয়টি থানা?
আরএমপি’র অধীনে বোয়ালিয়া, রাজপাড়া, শাহমখদুম ও মতিহার এই চারটি থানা।
রাজশাহী জেলার পৌরসভা কয়টি?
রাজশাহী জেলায় মোট ১৪টি পৌরসভা রয়েছে।
সেগুলো হচ্ছে – চারঘাট, বাঘা, আড়ানী, পুঠিয়া, কাটাখালী, নওহাটা, কাঁকনহাট, গোদাগাড়ি, মুন্ডুমালা, তানোর, দুর্গাপুর, ভবানীগঞ্জ, তাহেরপুর ও কেশরহাট।
রাজশাহীর বিখ্যাত ব্যক্তি
- *অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় – ভারতীয় ইতিহাসবেত্তা।
- *কুমার শরৎকুমার রায় – খ্যাতনামা ঐতিহাসিক।
- *যদুনাথ সরকার- কৃতবিদ্য ঐতিহাসিক।
- *কবি শুকুর মাহমুদ- মধ্যযুগের বাংলার নাথ সাহিত্য ধারার সম্ভবত শেষ কবি৷
- *রজনীকান্ত সেন- বাংলা সাহিত্যে ও সঙ্গীত জগতের অন্যতম সাধক কবি ও গীতিকার।
- *রাণী ভবানী।
- *মহারাণী হেমন্তকুমারী দেবী।
- *প্রমথনাথ রায়- রাজশাহী এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম।
- *মাদার বখ্শ- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা৷ ১৯৫১ সালে রাজশাহী শহরে তিনিই প্রথম রিক্সা চালু করেন৷
- *আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান- রাজনীতিবিদ ও জাতীয় নেতা।
- *চারু মজুমদার – মাওবাদী রাজনীতিবিদ।
- *হাসান আজিজুল হক – সাহিত্যিক।
- *গোলাম আরিফ টিপু – আইনজীবী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষা আন্দোলন কর্মী। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌসুলী।
- *সেলিনা হোসেন – বাংলাদেশী কথাসাহিত্যিক।
- *আবু হেনা – বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা।
- *এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন – রাজনীতিবিদ।
- *এন্ড্রু কিশোর – কণ্ঠশিল্পী।
- *খোদা বক্স মৃধা – ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার।
- *শাহরিয়ার আলম- পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও রাজনীতিবিদ।
- *ফজলে হোসেন বাদশা – রাজনীতিবিদ।
- *মিজানুর রহমান মিনু – রাজনীতিবিদ।
- * খালেদ মাসুদ পাইলট- ক্রিকেটার।
- *রিজিয়া পারভীন – কণ্ঠশিল্পী।
- *শর্মিলী আহমেদ – বিশিষ্ট নাট্য ও চলচ্চিত্র অভিনেত্রী।
- *ওয়াহিদা মল্লিক জলি – প্রখ্যাত মঞ্চ, নাট্য ও চলচ্চিত্র অভিনেত্রী এবং শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
- *নুসরাত ইমরোজ তিশা – অভিনেত্রী।
- *মাহিয়া মাহী – চিত্রনায়িকা।