সামরিক বাহিনীতে যোগ্য ও চৌকশ অফিসার তৈরির ভাবনা থেকে জার্মানির চ্যান্সেলর অটো ফন বিসমার্কের সময়ে ‘ক্যাডেট কলেজ’ ধারণার প্রবর্তন হয়। পরবর্তীতে সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট ফ্রান্সে এই ব্যবস্থা চালু করেন। ক্যাডেট কলেজে পাঠ্যক্রম বাস্তবায়নের পাশাপাশি ক্যাডেটদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, চারিত্রিক, সাংস্কৃতিক ও নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষা সম্পূরক বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। উল্লেখ্য, রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ বাংলাদেশের চতুর্থ ক্যাডেট কলেজ।
অবস্থান: রাজশাহী শহর থেকে ৩০ কিমি দূরে চারঘাট উপজেলার সারদায় পদ্মা নদীর তীরে মুক্তারপুর গ্রামে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ অবস্থিত। রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কের বানেশ্বর ট্রাফিক মোড় হতে বানেশ্বর-চারঘাট সড়কের সারদা ট্রাফিক মোড় দিয়ে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে যেতে হয়।
ইতিহাস: ঔপনিবেশিক পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত ৪র্থ ক্যাডেট কলেজ হলো ‘রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ’। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ১৯৬৪ সালের ৬ই নভেম্বর আয়ুব ক্যাডেট কলেজ নামে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান ১৯৬৬ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি আয়ুব ক্যাডেট কলেজের উদ্বোধন করেন। পদ্মা নদীর তীরে মুক্তারপুর গ্রামে ১১০ একর জমির উপর তিনটি হাউস (হোস্টেল) নিয়ে এ ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন উইং কমান্ডার মোহাম্মদ সাঈদ, পিএএফ। কলেজের প্রথম বাঙালি অধ্যক্ষ এম বকীয়তুল্লাহ। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আইয়ুব ক্যাডেট কলেজের নাম পরিবর্তন করে ‘রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ’ রাখা হয়। এই ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ক্যাডেটদের সংগঠন Old Rajshahi Cadets Association (ORCA)-অরকা নামে পরিচিত।
শিক্ষা ব্যবস্থা: রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে ক্যাডেটদের সপ্তম শ্রেণি হতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হয়। প্রত্যেক ক্লাসে গড়ে ৫০ জন ক্যাডেট ২ শাখায় (ফর্ম) বিভক্ত হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে। প্রত্যেক শাখা তদারকি করার জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত শিক্ষক (ফর্ম মাস্টার) রয়েছেন। গ্রীষ্মকালে সকাল ৮টা থেকে বেলা ১টা ( শনিবার হতে বুধবার) এবং সকাল ৭:৪০ হতে বেলা ১১:২০ টা পর্যন্ত ( বৃহঃবার) এবং শীতকালে সকাল ৮:২০ হতে বেলা ১:৫০ এবং ৮:২০ হতে বেলা ১:৩০ পর্যন্ত ( বৃহঃ বার) ক্লাস নেয়া হয়। ক্লাসের সময় ছাড়া প্রত্যেকদিন নিজ নিজ শ্রেণিকক্ষে লেখাপড়া করতে হয় (প্রিপারেটরি ক্লাস বা প্রেপ ক্লাস)। গ্রীষ্মকালে প্রেপ ক্লাস ৩টি। শীতকালের প্রেপ ২টি। দুর্বল ছাত্রদের জন্য খেলার সময়ে অতিরিক্ত প্রিপারেটরি ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়। ক্যাডেটদের যোগ্যতা মূল্যায়ন এবং শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষার (জেএসসি, এসএসসি এবং এইচএসসি) প্রস্তুতির জন্য স্পটটেস্ট, পাক্ষিক পরীক্ষা, প্রগ্রেস টেস্ট প্রভৃতি পরীক্ষা নেয়া হয়ে থাকে। ক্যাডেটদের শিক্ষা সংক্রান্ত এবং অন্যান্য বিষয়ের মূল্যায়ন নিয়মিত অভিভাবকদের অবহিত করা হয়।
অবকাঠামো: বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর ভবন রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। বিশাল এই দ্বিতল ভবনে রয়েছে- শ্রেণিকক্ষ, কম্পিউটার ল্যাব, ল্যাবরেটরি, মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাব, কেন্দ্রিয় লেকচার হল, অনুষদ, উপাধ্যক্ষের অফিস এবং স্টাফ লাউঞ্জ। একাডেমিক ব্লক সংলগ্ন আরেকটি স্থাপনা হল বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি মোস্তফা কামাল অডিটোরিয়াম। অডিটোরিয়ামটিতে আধুনিক মঞ্চ, অডিও ভিজুয়াল ইফেক্ট ও আলোক প্রক্ষেপণের সুব্যবস্থা রয়েছে। দ্বিতল এ অডিটোরিয়ামের দর্শক ধারণ ক্ষমতা ৬৫০জন। অডিটোরিয়ামের দক্ষিণ পূর্ব কোণে বীরশ্রেষ্ঠ মোঃ আব্দুর রউফ পাঠাগার। বিশ্বসাহিত্য, বিশ্বকোষ, মুক্তিযুদ্ধ এবং বিভিন্ন বিষয়ের রেফারেন্স বইয়ে কলেজের এ কেন্দ্রীয় পাঠাগারটি সমৃদ্ধ। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে ক্যাডেটদের আবাসনের জন্য ৩টি হাউস (হোস্টেল) রয়েছে। প্রখ্যাত মুসলিম বীর খালিদ বিন ওয়ালিদ, মুহাম্মদ বিন কাসিম এবং তারিক বিন যায়েদ এর নামানুসারে হাউস গুলোর নামকরণ করা হয়েছে- খালিদ হাউস, কাসিম হাউস এবং তারিক হাউস। সুসজ্জিত, সুরক্ষিত, একশ শয্যা বিশিষ্ট প্রত্যেকটি হাউসের সামনে রয়েছে সুন্দর বাগান।
প্রশাসন: ক্যাডেট কলেজ সমূহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল শাখা কর্তৃক সরাসরি নিয়ন্ত্রিত। একজন লে. কর্নেল ( কখনও নৌ/বিমান বাহিনীর সমমর্যাদার অফিসার) অথবা সিনিয়র শিক্ষক অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যক্ষ ক্যাডেট কলেজের সার্বিক বিষয়ে প্রধান দায়িত্ব পালন করেন। উপাধ্যক্ষ শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্ব পালন করেন। মেজর পদমর্যাদার একজন অফিসার (অ্যাডজুটেন্ট) প্রশাসনিক বিষয়ে অধ্যক্ষকে সহায়তা করেন। প্রত্যেক হাউসে একজন সিনিয়র শিক্ষক ‘হাউস মাস্টার’-এর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি হাউসের প্রশাসনিক বিষয় দেখাশোনা করেন। দক্ষ নেতৃত্ব গড়ে তোলা এবং কলেজ প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য দ্বাদশ শ্রেণি হতে একগুচ্ছ প্রিফেক্ট মনোনয়ন দেয়া হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান: ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ, শাসন ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে যে আন্দোলন দানা বেধে উঠছিল তা তৎকালীন আইয়ুব ক্যাডেট কলেজকেও প্রভাবিত করেছিল। কলেজের অধ্যক্ষ এম বকীয়তুল্লাহর নেতৃত্বে অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রশীদ, শিক্ষকবৃন্দ,কর্মচারীবৃন্দ এবং সকল ক্যাডেট অহিংস এবং অসহযোগ আন্দোলন সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেন। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ক্রমেই জটিল এবং অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার প্রেক্ষিতে উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের নির্দেশে ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ আইয়ুব ক্যাডেট কলেজ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং ক্যাডেটদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু ৭জন সাহসী ক্যাডেট বাড়িতে না গিয়ে রাজশাহী অবস্থান করে। সেই ৭ জন হল-
১) কলেজ প্রিফেক্ট ক্যাডেট মোশাররফ, দ্বাদশ শ্রেণি, ক্যাডেট নং ৩৭,
২) ক্যাডেট তালেবুল মওলা চৌধুরী, দ্বাদশ শ্রেণি, ক্যাডেট নং ৪৮,
৩) ক্যাডেট মনিশ দেওয়ান, দ্বাদশ শ্রেণি, ক্যাডেট নং ৭৪,
৪) ক্যাডেট খায়রুল, একাদশ শ্রেণি, ক্যাডেট নং ৭৮,
৫) ক্যাডেট আফজাল, একাদশ শ্রেণি, ক্যাডেট নং ৯৩,
৬) ক্যাডেট আমিন, একাদশ শ্রেণি, ক্যাডেট নং ১০৯ ও
৭) ক্যাডেট মনোয়ার, একাদশ শ্রেণি, ক্যাডেট নং ১২৫ ।
উল্লেখ্য,মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের ১৮ জন শহিদ হয়েছেন।
যোগাযোগঃ
টেলিফোন-07233-56088
ফ্যাক্স- 07223-56283
ই-মেইল: rcc_rajshahi@yahoo.com
তথ্যসূত্র:
https://rcc.army.mil.bd/
https://www.rajshahi.gov.bd/bn/site/page/N2BV-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A7%80-%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A1%E0%A7%87%E0%A6%9F-%E0%A6%95%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%9C