ক্লিন সিটি হিসেবে সুপরিচিত রাজশাহী মহানগরী আজ জরা-জীর্ণ নগরীতে পরিণত হয়েছে। নগরীর অনেক সড়ক প্রায় চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ভাঙা সড়কের পাশাপাশি ড্রেনেজ ব্যবস্থার বেহাল দশা। একটু বৃষ্টিতেই পানি জমছে রাস্তায়। প্রধান সড়কগুলোর ধারে পড়ে রয়েছে ময়লার স্তুপ। দুর্গন্ধে সড়ক দিয়ে চলাচলই দায়। ফুপটাত অবৈধ দখলদারদের কবলে। রাতে পর্যাপ্ত সড়ক বাতির অভাব। ব্যাটারিচালিত অটোরিকসার দৌরাত্বে মুখ থুবড়ে পড়েছে ট্রফিক ব্যবস্থার। এমত অবস্থায় নগরবাসী প্রতিক্ষায় প্রহর গুনছে তাদের নতুন মেয়রের জন্য। তাদের প্রত্যাশা নতুন মেয়র দায়িত্ব নিয়ে নগরবাসীর দুর্ভোগ লাঘবের পাশাপাশি নগরীর সেই পুরন জৌলুস ফিরিয়ে আনবেন।
এদিকে নগরবাসীর পাশাপাশি সদ্য বিজয়ী মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনও উন্মুখ হয়ে রয়েছেন দায়িত্ব বুঝে নিয়েই নগরবাসীর সেবায় কাজে নামতে। ৩০ জুলাই নির্বাচনের পরদিন নিজের জয় নিশ্চিত জানার পর নগরবাসীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করার পাশাপাশি তিনি দৃঢ প্রত্যয় ব্যক্ত করে জানিয়েছেন, আগামী ১০০ দিনের মাধ্যেই এই নগরীকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা হবে। রাসিক নির্বাচনে জয়ী হবার পর ঢাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাসহ প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে ৩ আগস্ট ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন রাজশাহীর নবনির্বাচিত মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন।
শুক্রবার রাতের তিনি রাজশাহীতে ফিরে এসে জানান, প্রধানমন্ত্রী রাজশাহীবাসীর প্রতি অত্যন্ত খুশি। রাজশাহীর উন্নয়নে যা যা দরকার, যত প্রকল্প দরকার; সব প্রদানের আশ^াস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। রাজশাহীবাসীর আর কোনো দুর্ভোগ থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন রাজশাহীতে এখন দ্রুতগতিতে উন্নয়ন হবে। অল্প দিনের মধ্যেই রাজশাহীর উন্নয়ন শুরু হবে।
নগরবাসীর দেয়া তথ্য মতে, ২০০৮ সালে খায়রুজ্জামান লিটন মেয়র নির্বাচিত হবার পর তিনি স্বউদ্যোগে এই নগরীকে পরিচ্ছন্ন করে সাজিয়ে তুলেন। রাজশাহী নগরীকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন অনন্য এক নগরী হিসেবে। এনে দিয়েছিলেন নির্মল বায়ুর নগরী’র খেতাব। এছাড়াও নগরীর প্রতিটি সড়ক সংস্কার করার পাশাপাশি সড়কগুলোকে প্রশস্থ করার কাজও করা হয় তার সময়কালে। পাশাপাশি রাসিকের পরিচ্ছন্ন কর্মীদের মাধ্যমে বাসায় বাসায় গিয়ে প্রতিদিনকার ময়লা-আবর্জনা তুলে নিয়ে আসা শুরু করা হয় খায়রুজ্জামান লিটন মেয়র থাকা কালীন সময় থেকেই। নগরীর ধুলিকণা নিয়ন্ত্রণে রাতে নগররীর প্রধান সড়কগুলো পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের দিয়ে ঝাড়– দেয়ার কাজ শুরু করা হয়। এর বাইরে নগরীবাসীর পাশাপাশি বাইরের পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে নদীতীরবর্তী এলাকাগুলো সৌন্দর্যমন্ডিত করা হয়। লালশাশাহ মুক্ত মঞ্চ এর মধ্যে অন্যতম। এর সবই হয়েছে তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে।
পাশাপাশি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নিজস্ব আয়ের পথ তৈরির লক্ষে রাসিকের নিজস্ব ভূমিতে তিনি সিটি সেন্টার ও দারুচিনি প্লাজাসহ বেশ কয়েকটি মার্কেট নির্মানের উদ্যোগ নেন। পাশাপাশি রাসিকের তত্ত্বাবধানে প্রইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল সেই সময়। আর এই সকল উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্যই ছিল রাসিকের আয়ের জন্য নগরবাসীর ওপর বাড়তি করের বোঝা না চাপান। প্রাপ্ত তথ্য মতে খায়রুজ্জামান লিটন মেয়র থাকাকালীন প্রায় ৮৫০ কোটি টাকা ব্যায়ে নগরীর বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ করা হয়েছে বা চলমান ছিল।
তবে ২০১৩ সালের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হওয়ায় নগরীর সকল উন্নয়ন থমকে যায়। ২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত হওয়া উন্নয়নের চিহ্নগুলোও ধিরে ধিরে নষ্ট হতে থাকে। পর্যটন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত নদীর ধারে লালনশাহ মঞ্চের কাছে আজ গরুর গোয়াল, যেখানে রয়েছে শাতধিক গুরু। গুরুর গোবরসহ মলমূত্রের দুর্গন্ধে এই এলাকায় যাওয়াই দ্বায়। নগরীর প্রায় প্রতিটি রাস্তা পরিকল্পনার অভাবে আজ জরা জীর্ণ ও খানাখন্দে পূর্ণ। নগরীর তালাইমারি থেকে ঢাকা বাস টার্মিনাল, ভদ্রা পদ্মা আবাসিকের প্রবেশ পথ, ভদ্রা থেকে নদাপাড়া বাস টার্মিনালসহ ওলিগোলির রাস্তাগুলো এখন প্রায় চলাচলের অযোগ্য। নির্মল নগরী খালাখন্দরের শহর। একটু বৃষ্টিতেই পানি জমে শহরের প্রধান সড়কসহ ওলিগলির রাস্তাগুলোতে।
তবে সদ্য বিদায়ী মেয়রের অভিযোগ ছিল তিনি সরকারের সহযোগীতার অভাবে ইচ্ছা থাকা সত্বেও কাজ করতে পারেননি। এদিকে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ সিটি কর্পোরেশনের রয়েছে নিজস্ব জনবলসহ পরিচ্ছন্নতা কর্মী। তাদেরকে কাজে লাগাতে সকরারের সহযোগীতার প্রশ্নই আসে না। জনদুর্ভোগ লাঘব করতে এসময়ে প্রয়োজন ছিল মেয়রের নিজস্ব উদ্যোগের, আর সেই উদ্যোগেরই অভাব ছিল সদ্য বিদায়ী মেয়রের।
পদ্মা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা সজিব বলেন, দীর্ঘ প্রায় ৫ বছর ধরে আবাসিকের প্রবেশদ্বারের এই সড়কটি ভেঙে পড়ে রয়েছে। এই সড়কদিয়ে আন্ত জেলার বাস যাতায়ত করে ফলে এই ভাঙা সড়ক এখন খাদে পরিণত হচ্ছে। এছাড়া তালাইমারি স্টেসন সড়টিতো এখন নগবাসীর বিষফোঁড়া। একটি লেন ঠিক না করে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠনটি এক সাথে দুই লেনের কাজ শুরু করেছে। ফলে এখন এই সড়কটি আর চলাচলের উপযোগী নেই।
এদিকে গত ১০বছর আগে নগরীর বাসা-বাড়িতে গ্যাস সংযোগ চালু হবার পর থেকে সড়ক কেটে গ্যাসের লাইন দেয় শুরু হয়। এতে করে ভালো অবস্থায় থাকা অনেক রাস্তাগুলোও এখন খানাখন্দে ভরে গেছে। দীর্ঘদিন এই রাস্তাগুলো সংস্কার না করায় এখন সেই রাস্তাগুলো নগরবাসীর দুর্ভোগের অন্যতম প্রধান কারণ। অথচ গ্যাস সংযোগের সময় রাস্তা খোড়ার জন্য রাজশাহী সিটি করপোরেশন ঠিকই লাইন প্রতি টাকা কেটে রেখেছে।
সাহেববাজর, নিউমার্কেট, শিরোইল, সাগরপাড়া, লক্ষ্মিপুরসহ আশাপাশের জনবগুল এলাকাগুলোর মোড়গুলো আজ অবৈধ ফুটপাত দখলদারদের কবলে। এই ফুটপাত দখলদারদের কারণে সাধারণ নগরবাসীর পায়ে হাটা পথ খুঁজে পাওয়াই দায়। এদিকে রাজশাহী নগরীতে অনিয়ন্ত্রিত হারে বাড়ছে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা। এই অটোরিকশার দৌরাত্বে নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। নতুন অটোরিকশা সড়কে নামানোয় বিধিনিষেধ থাকা সত্বেও প্রতিদিন নতুন অটোরিকশা নেমেই চলেছে। অভিযোগ রয়েছে এ কাজে সহযোগীতা করছে স্বয়ং রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের অসাধু কিছু কর্মচারী। এছাড়া রাতে নগরীর বিভিন্ন এলাকার সড়কগুলোতে নেই পর্যপ্ত সড়ক বাতি। বিদ্যুতের পোলগুলোতে একবার বাল্ব কেটে গেলে তা লাগাতে মাসের পর সাম পর হয়ে যায়। ফলে নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন নগরবাসী।
এর বাইরে রেশম ভবনের কাছের সড়কের ধারে, সিরোইল কলোনির প্রবেশ দ্বারের সড়কের ধার, বিনোদপুর সড়কের ধার, কোর্টের কাছের হটিকালচার সড়কের ধার সহ নগরীর প্রায় প্রতিটি এলাকার প্রধান সড়কের ধারে ময়লা স্তুপ করে ফেলে রাখা হয়েছে। এতে করে নগরবাসীর যাতায়তে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
সিরোইল কলোনির বাসিন্দা আব্দুল কাদের বলেন, আমাদের কলোনির প্রবেশদ্বারে দিন-রাত ময়লা স্তুপ করে ফেলে রাখা হচ্ছে। ফলে এই এলাকা দিয়ে যাতায়াত করতে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এলাকাবাসী সহ রাস্তাটি দিয়ে যাতায়তকারীদের। গত ৫বছরে রাজশাহী নগরী ভাগারে পরিণত হয়েছে। চলছে বর্ষা মৌসুম। এখন ঘন্টা ব্যাপি বৃষ্টি হলেই নগরীর প্রায় প্রতিট রাস্তায় হাটু পানি জমে। নগরবাসীর অভিযোগ সুষ্ঠ ড্রেনেজ ব্যবস্থার অভাবেই এই জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে।
পর্যায়ক্রমে নগরীর উন্নয়নগুলো নষ্ট হবার পাশাপাশি দুর্ভোগ বৃদ্ধির কারণে নগরবাসী অতিষ্ট। আর এই দুর্ভোগ থেকে প্ররিত্রাণের লক্ষে এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নগরবাসী তাদের নতুন নগর পিতা নির্বাচন করেছেন। তাদের একটাই চাওয়া নতুন নগর পিতা তার দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে কাজ করবেন। রাজশাহীবাসীকে তাদের বর্তমান দুর্ভোগ থেকে পরিত্রাণ দিবেন।
খবর কৃতজ্ঞতাঃ ডেইলি সানশাইন