‘বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি’- বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অহংকার। এখান থেকেই কঠোর অনুশীলন আর সমসাময়িক ধ্যান-ধারণায় প্রশিক্ষিত হয়ে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন বাংলাদেশের পুলিশ সদস্যগণ।
অবস্থান:
রাজশাহী জেলার চারঘাট উপজেলার সারদা-তে।
যাতায়াত:
বাস যোগে রাজশাহী শহর হতে সরাসরি বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে যাওয়া যায়। দূরত্ব ২৮ কিলোমিটার, ভাড়া প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ টাকা জনপ্রতি। এছাড়া চারঘাট উপজেলা সদর হতে ভ্যান, ইজি বাইক প্রভৃতি যানবাহনেও এখানে যাওয়া যায়, দূরত্ব প্রায় ১ কিলোমিটার এবং ভাড়া প্রায় ১৫ টাকা থেকে ২০ টাকা।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
১৮৬১ সালে এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম ইউনিফর্মধারী পুলিশের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। এর ৩২ বছর পর পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করে তার নামকরণ হয় ‘ট্রেনিং স্কুল’। স্কুল থেকে ট্রেনিং কলেজ, কলেজ থেকে একাডেমি। এটাই সারদা পুলিশ একাডেমির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
বিস্তারিত:
ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে অন্যতম পুরোনো পুলিশের ট্রেনিং একাডেমি ‘বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি’। ১৯১২ সালের জুলাই মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে এর যাত্রা শুরু হয়। কালের আবর্তে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।
১৮৬১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশ বাহিনীর শুরুর ৩২ বছর পর তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ১৮৯৩ সালে পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকার মিলব্যারাকে পরীক্ষামূলকভাবে পুলিশ সদস্যদের জন্য ১২ মাসের ট্রেনিং কার্যক্রম শুরু হয়। এ কার্যক্রমে পুলিশের মানোন্নয়নে ব্যাপক সফলতা আসে। ১১ বছর পর ১৯০২ সালে মিলব্যারাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশ ট্রেনিং স্কুলের অনুমতি দেয় সরকার। ১৯০৬ সালে ট্রেনিং স্কুলকে করা হয় ট্রেনিং কলেজ। অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান তৎকালীন ব্রিটিশ মেজর এইচ. চ্যামেনি।
অধ্যক্ষ চ্যামেনি ঢাকা থেকে স্টিমারে কোলকাতা যাওয়ার পথে একাডেমির স্থান অনুসন্ধানের জন্য রাজশাহীর পদ্মা নদী তীরবর্তী (সারদা) চারঘাটে থামেন। এখানকার মনোরম পরিবেশে বিশেষ করে বিশাল আম বাগান, সুউচ্চ বড় বড় কড়ই গাছ ও প্রমত্তা পদ্মার বিশালতায় মুগ্ধ হন তিনি।
এখান থেকে ফিরে গিয়েই তিনি সারদায় পুলিশ একাডেমির স্থান নির্ধারণের জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রস্তাব দেন। ওই জায়গার মালিক ছিলেন মেদিনীপুরের জমিদার। সরকার জমিদারের কাছ থেকে ২৫ হাজার টাকায় একাডেমির জন্য ১৪২ দশমিক ৬৬ একর জায়গা কিনে নেন। তখন এলাকাটি ছিল ঘন জঙ্গলে ঠাসা। ছিল হিংস্র বাঘের উপদ্রব। জনশ্রুতি আছে এলাকায় বাঘের উপদ্রব থাকার কারণে বলা হতো, শেরদা (এর অর্থ ছিল বাঘের গ্রাম)। পরে শেরদা থেকে সারদা নামকরণ হয়।
বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি নামকরণ:
শুরুতে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির নাম রাখা হয় ‘সারদা পুলিশ সেন্টার’। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর (ভারত-পাকিস্তান) সারদা পুলিশ সেন্টারকে ট্রেনিং কলেজ নামকরণ করা হয়। ১৯৬২ সালে উদযাপিত হয় পঞ্চাশ বছর পূর্তি (গোল্ডেন জুবিলি)। ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। সে সময় আরেক দফা নাম পরিবর্তন হয়। পুলিশ ট্রেনিং কলেজ থেকে পুলিশ একাডেমি। সর্বশেষ ২০০৭ সালে নামকরণ হয় ‘বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি’।
সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে রয়েছে সুবিশাল প্যারেড গ্রাউন্ড, প্রিন্সিপাল, ভাইস প্রিন্সিপালের জন্য বিশাল বাংলো, প্রশাসনিক ভবন, পুলিশ সুপারের বাসভবন, একাডেমিক ভবন, অফিসার্স মেস, সহকারী পুলিশ সুপারদের ডরমেটরি, প্রশিক্ষণরত সাব-ইন্সপেক্টর ও কনস্টেবলদের ডরমেটরি, ভিআইপি অতিথির জন্য গেস্ট হাউজ, চ্যামেনি মেমোরিয়াল অডিটোরিয়াম, হাসপাতাল, অশ্ব ট্রাক এবং প্লেয়ার হল ও মসজিদ।
বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির বর্তমান প্রিন্সিপাল/ অধ্যক্ষ:
পুলিশ একাডেমির বর্তমান প্রিন্সিপাল (অতিরিক্ত আইজিপি) জনাব মীর রেজাউল আলম, বিপিএম (বার)।
ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণসমূহ:
পুলিশ একাডেমি সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী এখানে কনস্টেবল থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন মেয়াদে ট্রেনিং দেওয়া হয়। এর মধ্যে শিক্ষানবিশ এএসপি ১২ মাস, শিক্ষানবীশ সাব-ইন্সপেক্টর ১২ মাস, বিভাগীয় সাব-ইন্সপেক্টর ৬ মাস, সার্জেন্ট ৬ মাস, শিক্ষানবীশ কনস্টেবল ৬ মাস।
এছাড়া নিয়মিত কনস্টেবল ৬ মাস, রিডার (কনস্টেবল) ৬ মাস, বিভাগীয় এএসপি ৪ সপ্তাহ, ইন্সপেক্টর নিরস্ত্র ৬ সপ্তাহ, ইন্সপেক্টর সশস্ত্র ৬ সপ্তাহ, নিরস্ত্র সাব-ইন্সপেক্টর ৮ সপ্তাহ, সশস্ত্র সাব-ইন্সপেক্টর ৮ সপ্তাহ, সার্জেন্ট, ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) ৮ সপ্তাহ, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) ৮ সপ্তাহ, প্রধান কনস্টেবল (নিরস্ত্র) ৮ সপ্তাহ, প্রধান কনস্টেবলদের (সশস্ত্র) ৮ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
ভৌত অবকাঠামো:
বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির ভৌত কাঠামো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। ২০০০ আসন বিশিষ্ট কুঠিবাড়ি আকৃতির কাঠামোয় এটি প্রতিষ্ঠিত। এখানে রয়েছে অধ্যক্ষের বাংলো এবং এসপি, অতিরিক্ত এসপি, এএসপি, নতুন প্রশিক্ষণার্থী, মহিলা অফিসার, ইন্সপেক্টর, সাব-ইন্সপেক্টর, সার্জেন্ট, প্রধান কনস্টেবল, কনস্টেবল এবং ভৃত্যদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা।
প্রিয় পাঠক, ‘বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি’-তে ভ্রমণের জন্য পূর্বানুমতির প্রয়োজন হয়। শিক্ষাসফর বা ভ্রমণের জন্য অফিস চলাকালীন সময়ে কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে অনুমতি নিতে হয়।