পবা উপজেলা বসন্তপুর গ্রামের সুশান্ত পাল পেশায় একজন মাটির তৈরি তৈজসপত্রের কারিগর। বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী এই পেশা তিনি ধরে রেখেছেন। পেশায় এনেছেন নতুন মাত্রা ও বৈচিত্র। বৈশাখ আসলেই তার কদর বাড়ে। তার হাতের তৈরি বাহারি রঙের ‘শখের হাড়ি’ দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও খ্যাতি অর্জন করেছে। তবে এবার বৈশাখ আসলেও বিবর্ণ পাল পাড়া।
মাটির তৈরি তৈজসপত্রের চাহিদা কমায় সারা বছর ব্যবসা থাকে না। তবে তিনি গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈরি অন্যতম তৈজসপত্র হাড়িকে রাঙিয়ে বিভিন্ন আকারের কয়েকটিকে একত্রে করে ছিকায় পুরে নান্দনিক এক রূপ দিয়েছে। যার নাম রেখেছেন ‘শখের হাড়ি’। প্রতি বছর বৈশাখ আসলে তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই শখের হাড়ি তৈরির অর্ডার পান। শখের হাড়ির পসরা নিয়ে অশং নেন ঢাকায় বৃহৎ আকারে আয়োজিত বৈশাখি মেলায়।
প্রতিবারের মতো এবারো তিনি একটি স্কুল থেকে এক লাখ টাকার সখের হাড়ি বানানোর অর্ডার পেয়েছিলেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে সেই অর্ডার বাতির করা হয়েছে। তবে অর্ডার বাতিলের আগেই তিনি সেই অর্ডার অনুযায়ী পণ্য তৈরি করেন। তর ভাষায় এখন তার শ্রম ও অর্থ দুই আটকে গেলো।
সমর কুমার পাল বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশে বৈশাখ কেন্দ্রিক সকল আয়োজন ও অনুষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কারো দোষ নেই, পরিস্থিতিটাই এমন। তবে এতে করে আমি বড় ক্ষতির মুখে পড়েছি। শহরের মতো গ্রামেও এখন মাটির তৈরি তৈজসপত্রের চাহিদা নেই। তবে বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমরা মাটির তৈরি ঐতিহ্যবাহী পণ্য নিয়ে বিভিন্ন মেলায় অংশ নেই। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও এসব পণ্যের আর্ডার আসে। বৈশাখি মেলাকে কেন্দ্র করে মেলায় অংশ নিতে ও অর্ডার মিলিয়ে প্রতি বছর আমি প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার মাটির তৈরি পণ্য ‘সখের হাড়ি’ তৈরি করে থাকি। খরচ বাদে এর লাভ দিয়েই সারা বছর সংসার চালাই। তবে এবার পুরোটাই জলে গেলো। তিনি আরো জানান, বসন্তপুর গ্রামে তার মতো ৫২টি পাল পরিবার রয়েছে। বৈশাখ মাস আসার আগেই এই পরিবারগুলোর তৈরি মালামাল বিক্রি হয়ে যায়। তবে এবার উঠোন ও উনোন জুড়ে মাল ওমনিই পড়ে আছে। এমন দুর্দিনে কোনো পক্ষ থেকে তাদেরকে কোন প্রকার অনুদান বা সহায়তাও করা হয়নি।
করোনা পরিস্থিতির কারণে পাল পাড়ার মতো রাজশাহী নগরীর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সাথে জড়িতরাও বিপাকে পড়েছেন। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন প্রায় কয়েক হাজার কর্মী ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী মহলের দাবি, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে সামনে ঈদেও তাদের ব্যবসা বন্ধ থাকবে। পূজি হারাবে ব্যবসায়ীরা, কর্মহীন হবে হাজারো শ্রমিক। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীদের মতে পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে শুধু রাজশাহী নগরীতেই প্রায় ৪ কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে। আর ঈদকে কেন্দ্র করে পুরো রাজশাহী জুড়ে পোশাক, পাদুকা ও প্রশাধনীসামগ্রীর ব্যবসা হয়ে থাকে প্রায় ১০ কোটি টাকা।
পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বুটিকসহ হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর কদর কয়েকশ গুণ বৃদ্ধি পায়। এই পণ্যগুলোর পুরোটা জুড়েই থাকে দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। আর এই পণ্যগুলোর বড় অংশই ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংশ্লিষ্টরা তৈরি করে থাকেন। পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে রঙিন পাঞ্জাবি, ফতুয়া, সালোআর, ওড়না; মাটি, কাঠ, কাপড় ও মেটালের তৈরি গহনা; পাখা, হাতে তৈরি খেলনা ও ঘর সাজানোর রংবেরঙের সামগ্রী। বৈশাখকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কেন্দ্রিক প্রায় ৪ থেকে ৫ কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে রাজশাহী নগরীতে। তবে এবার বৈশাখি অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে, আর তাই সেই ব্যবসা পুরোটাই বন্ধ।
রাজশাহীর সপুরায় অবস্থিত বিসিক শিল্প নগরীতে অবস্থিত ঊষা সিল্ক। প্রতিষ্ঠানটি একাধারে সিল্কের পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে থাকেন। কারখানার সাথেই তাদের রয়েছে নিজস্ব শোরুম। ক্ষুদ্র ও কুটিশ শিল্প শ্রেণীর এই প্রতিষ্ঠানটিতে ৩০জন কারিগর ও কর্মচারী রয়েছে। ঊষা সিল্কের মতো এখানে রয়েছে আরো প্রায় ১০টির মতো প্রতিষ্ঠান। প্রতি বছর এই বৈশাখকে কেন্দ্র করে বিসিক শিল্প নগরীতে অবস্থিত সিল্ক পাড়ায় ব্যবসা হয়ে থাকে প্রায় এক কোটি টাকা। আর ঈদ আসলে সেই ব্যবসা গিয়ে দাড়ায় ৪ থেকে ৫ কোটির গরে। বিসিকের সিল্ক পাড়ায় সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০ জন কারিগর ও কর্মচারী কাজ করতো। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে মার্চের শেষের দিক থেকে কারখানা ও শোরুমগুলো বন্ধ থাকায় তাদের সবাই এখন ঘরবন্দি জীবন পার করছেন।
ঊষা সিল্কের জেনারেল মেনেজার জহুরুল ইসলাম জহির জানান, পুরো বছর জুড়ে আমরা বসে থাকি শুধুমাত্র এই বৈশাখ ও ঈদের জন্য। এই দুই অনুষ্ঠানকে ঘিরে যে ব্যবসা হয় তা দিয়েই আমরা পুরো বছর চলি। তবে এবার বৈশাখের পুরো ব্যবসাই বন্ধ। ঈদ নিয়েও কোন আশা দেখছি না। আমাদের কর্মচারীদের মার্চের বেতন এপ্রিলের ৫ তারিখের মধ্যেই দিয়ে দিয়েছি। পুরো এপ্রিল ব্যবসা বন্ধ থাকলেও বেতনতো দিতে হবে সবাইকে। এভাবে ব্যবসা বন্ধ থাকলে জানি না আগামীতে আমাদের কী হবে। করোনা পরিস্থিতির কারণে আমাদের মতো সবারই অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তেমনি কারিগরেরাও কর্মহীন সময় পার করছেন। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমাদের সমনে আরো একটি বড় চ্যালেঞ্জ আসতে চলেছে। প্রকৃত অর্থনৈতিক ক্ষতি ও আমাদের সক্ষমতার বিষয়টা হয়তো তখনই বোঝা যাবে।
খবর কৃতজ্ঞতাঃ দৈনিক সানশাইন