ঈদের আর মাত্র কয়েক দিন বাকি। কিন্তু পশুর হাটগুলোতে ক্রেতাদের দেখা নেই। করোনাকালে সৃষ্ট আর্থিক সংকটে পড়া মানুষ এবার হাটের খোঁজও নিচ্ছে না। মন্দা বাজারে ভ্যাপসা গরম আর দুশ্চিন্তায় রীতিমতো ঘামছেন ব্যাপারীরা। বন্যাদুর্গত এলাকা থেকে আসা এসব ব্যাপারীর অনেকেরই গরু নিয়ে ফেরার জায়গাটুকুও নেই। আর করোনা মহামারির এই সময়ে পশুর হাটগুলো মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কুষ্টিয়ার গরুর ব্যাপারী ইকরামুল হক মাঝারি ও বড় আকারের ১৪টি গরু এনেছেন পুরান ঢাকার ধূপখোলা হাটে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে প্রত্যাশিত দাম পাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন তিনি। ইকরামুল হক বলেন, এবার বড় ১১টি ও ছোট ৩টি গরু এনেছেন। কিন্তু করোনায় পশুর হাটে বেচাকেনা জমবে কি না, সেই উদ্বেগে অন্যদের মতো তিনিও। এ পরিস্থিতিতে লাভ না হোক, অন্তত চালান নিয়ে যেন ঘরে ফিরতে পারেন—সেই চেষ্টাই করছেন বলে জানান।
গত রোববার ধূপখোলা হাটে গিয়ে দেখা গেল, অন্তত ৪০ জন ব্যাপারী ও খামারি পাঁচ শতাধিক পশু এনেছেন। তাঁদের চোখেমুখেও ইকরামুলের মতো শঙ্কা। ধূপখোলা হাটের ইজারাদার হাসান আসকারি। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে পশুর ভালো
দাম পাওয়া নিয়ে অনেক ব্যাপারী তাঁকে দুশ্চিন্তার কথা জানিয়েছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) শর্ত অনুযায়ী আজ মঙ্গলবার থেকে হাটে আনুষ্ঠানিকভাবে বেচাকেনা শুরু হবে।
আজ মঙ্গলবার থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) ১১টি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় ৫টি অস্থায়ী পশুর হাট বসবে। এ ছাড়া ডিএসসিসির সারুলিয়া ও ডিএনসিসির গাবতলী স্থায়ী হাটেও কোরবানির পশু বেচাকেনা শুরু হবে।
ধোলাইখাল হাটে শরীয়তপুর থেকে ২৪টি গরু নিয়ে এসেছেন ব্যাপারী কুদ্দুস আলী। রোববার দিনভর এসব গরু বাধা, খাবার দেওয়া, গোসল করা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছেন তিনি। আলাপকালে তিনি বলেন, তাঁর কাছে চার লাখ থেকে এক লাখ টাকা দামের গরু রয়েছে। এবার এসব গরু নিয়ে চতুর্মুখী সমস্যায় পড়তে হয়েছে। শরীয়তপুরে বন্যায় বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে পদ্মার ভাঙনও শুরু হয়েছে। এখন গরু বেচতে না পারলে এগুলো নিয়ে বাড়ি ফেরারও উপায় নেই। তাই লাভ চান না, চালান বাঁচাতে পারলেই খুশি।
গোপীবাগ বালুর মাঠ হাটেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ট্রাকে ট্রাকে গরু আনছেন ব্যাপারী ও খামারিরা। এতে হাটের সীমানা গোপীবাগ থেকে কমলাপুর স্টেডিয়াম পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে। তবে কাউকে দরদাম করতে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ মাংস বিক্রেতা সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বলেন, ঢাকা শহরে প্রতিবছর গড়ে সাড়ে চার লাখ পশু কোরবানি হতো। এবার করোনার কারণে তা কমে সাড়ে তিন লাখের মধ্যে চলে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিবছর রাজনৈতিক নেতা এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকেরা বেশিসংখ্যক গরু কোরবানি দিতেন। এবার করোনার কারণে তাঁদের অনেকেরই অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকে এবার কোরবানি দিতে হিমশিম খাবে। এতে ঢাকায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ গরু কম বিক্রি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দাম নিয়ে শঙ্কায় উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী সিটি হাটের ব্যাপারীরাও। করোনার স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে কোনো বালাই নেই এখানে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ময়লার ভাগাড়–সংলগ্ন এই হাটে দুর্গন্ধে টেকাই দায়। তার ওপরে যুক্ত হয়েছে বৃষ্টিতে আবর্জনার থকথকে কাদা। গত রোববার দুপুরে ভাগাড়ের মধ্যে কাদাপানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় রাজশাহীর মোহনপুরের আব্বাস আলীকে। তাঁর তিনটি গরুর মধ্যে একটি দাম উঠেছে মাত্র ৮০ হাজার টাকা। অথচ এক মাস আগে এক ক্রেতা বাড়িতে গিয়ে গরুটির দাম ৯০ হাজার টাকা বলেছিলেন। হাটে বেশি দাম পাওয়ার আশায় তখন বিক্রি করেননি। এখন দাম কমে যাওয়া এবং হাটের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে ত্যক্তবিরক্ত আব্বাস। রাজশাহীর ক্রেতারা জানাচ্ছেন, সিটি হাটে এবার গরুর দাম গতবারের চেয়ে বেশ কম। হাটের সামনে থেকে ৬০ হাজার টাকায় একটি কালো রঙের ষাঁড় কিনেছেন রাজশাহী নগরের কাজীহাটা এলাকার নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এবার গরুর দাম খুবই কম। যে গরুটি ৬০ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছেন, তা আগের ঈদে কিনতে কমপক্ষে ৮০ হাজার টাকা লাগত।
সিটি হাটের ইজারাদার আতিকুর রহমান বলেন, এবার বেচাকেনা খুব কম। তাঁরা সামাজিক দূরত্বসহ স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখতে সব চেষ্টা করছেন। তবে খুব একটা সফল হচ্ছেন না।
পশুর হাটে স্বাস্থ্যঝুঁকি
তবে করোনার এই সময় পশুর হাট মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করবে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদ মুস্তাক হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, করোনা সংক্রমণে পশুর হাট খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এবার রাজধানীতে পশুর হাট ইজারা না দিতে সুপারিশ করেছিল জাতীয় কারিগরি কমিটি। একই বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কোনো নির্দেশনা মানেনি।
গতকাল সোমবার বিকেলে ধানমন্ডি লেকে এক অনুষ্ঠানে ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘ডিএসসিসি এলাকার আটটি সংসদীয় আসনের কথা বিবেচনা করে ১১টি পশুর হাট ইজারা দিয়েছি। এসব হাট সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনার জন্য ইজারাদারদের নিয়ে সভা হয়েছে। সেখানে ইজারাদারদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে হাট পরিচালনার জন্য কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। হাটে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে আজ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। কেউ ইজারার শর্ত ভঙ্গ করলে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব।
খবর কৃতজ্ঞতাঃ প্রথম আলো