টইটম্বুর এখন রাজশাহীর পদ্মা। সারাবছর তেমন পানি না থাকলেও বর্ষার পর মাস দুয়েক পানিতে ঢেউ তুলে পদ্মা। এই সময় রাজশাহীর পদ্মায় নৌকায় চড়ে ভ্রমণপিপাসুরা উত্তাল নদীবক্ষে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু নৌ-ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করায় পদ্মায় একের পর এক নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। তবুও ঝুঁকি নিয়ে আনন্দ ভ্রমণে মেতে উঠেন পদ্মায় ঘরতে আসা মানুষ।
গত ৩ বছরে রাজশাহীর পদ্মায় নৌ-দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ১৮ জনের। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই প্রতিদিন ভ্রমণপিপাসুরা ঘুরছেন মাঝনদী। দুর্ঘটনা ঘটলে এ নিয়ে কিছুদিন আলোচনা হয়, মেলে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস, কিন্তু দুর্ঘটনার রেশ কাটতেই সবকিছু মিলিয়ে যায়। বছরের পর বছর পদ্মায় নৌ-যান চলছে নানা অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেই।
নৌ-ভ্রমণে লাইফ জ্যাকেট বাধ্যতামূলক হলেও এসব ছোট ছোট নৌকার বেশিরভাগেরই তা নেই। আর যাদের আছে তারাও লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করেন না। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীরা নৌকায় চড়ছেন।
এদিকে নৌকায় অতিরিক্ত যাত্রী বহন না করার নির্দেশনা থাকলেও তা অমান্য করে ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ যাত্রী ওঠানো হচ্ছে প্রতিদিন। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে পদ্মার বুকে, সঙ্গে স্রোতও। ঢেউ ও স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়েই চলছে ডিঙি নৌকা, মাছ ধরা নৌকা ও ইঞ্জিনচালিত নৌ-যানগুলো।
নৌ-যানে ত্রুটি, চালকের অদক্ষতা, ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা, নিরাপত্তা নির্দেশনা অমান্য করা, চলার পথে দুই নৌকার মধ্যে প্রতিযোগিতা, বেপরোয়া চালানো, সম্ভাব্য দুর্ঘটনার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি না থাকার কারণে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।
সর্বশেষ গত ২৫ সেপ্টেম্বর পদ্মায় নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে। ১৫ জন যাত্রী নিয়ে একটি নৌকা নদীতে ডুবে যায়। দুর্ঘটনায় ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এআইইউবি) বিবিএ তৃতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী সাদিয়া ইসলাম সূচনা ও তার চাচাতো ভাই রিমন নিখোঁজ হন। ঘটনার আটদিন পর পদ্মায় তাদের দু’জনের মরদেহ ভেসে ওঠে। পরে স্থানীয়রা ভাই-বোনের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশের কাছে দেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত তিন বছরে পদ্মায় নৌ-দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১৮ জনের। এছাড়াও নদীতে চলন্ত নৌকা থেকে যাত্রীদের পড়ে যাওয়ার ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছেই। ২০১৭ সালের মে মাসে মহানগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় ঝড়ের কবলে পড়ে পদ্মায় ডুবে মারা যান পাঁচজন। এরপর ২০১৮ সালে প্রাণ হারান অন্তত দুইজন।
গত বছরের ১৫ জুলাই মহানগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় চলন্ত নৌকা থেকে পড়ে যান দুই তরুণী। নৌকার কাঠের বেঞ্চসহ উল্টে পড়ে যান তারা। এরপর এই বেঞ্চটাকেই আকড়ে ধরে বেঁচে যান তারা। পদ্মায় সাম্প্রতিককালের বড় দুর্ঘটনা ঘটে চলতি বছরের ৬ মার্চ। মহানগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় বর-কনেসহ ডুবে যায় দুটি নৌকা। এ ঘটনায় বিয়ের পরদিনই দুই শিশুসহ নয়জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।
রাজশাহীর পদ্মা নদীর টি-বাঁধে গিয়ে দেখা যায়, নদীর পাড়ে ১০-১২টি নৌকা রয়েছে। ২০ টাকার বিনিময়ে ভ্রমণপিপাসুদের কিছুক্ষণের জন্য পদ্মায় ঘুরিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। এসব নৌকার কোনোটিতেই লাইফ জ্যাকেট দেখা যায়নি। দুই একটি নৌকার একপ্রান্তে লাইফ জ্যাকেট পড়ে থাকতে দেখা গেলেও কাউকে পড়তে দেখা যায়নি। ইঞ্জিনচালিত ডিঙি আকৃতির ছোট নৌকাগুলোতে ১৫-২০ জন যাত্রী উঠানো হচ্ছে যা ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি। জীবনের মায়া ছেড়ে কেবলমাত্র শখের বসে এমন ঝুঁকিপূর্ণভাবে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীর এবং শিশুরাও বাবা-মায়ের সঙ্গে নৌকায় উঠছেন।
স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, পদ্মায় চলাচলকারী নৌকাগুলোতে লাইফ জ্যাকেট থাকে না। কোন কোন নৌকায় থাকলেও যাত্রীর তুলনায় অপ্রতুল। আবার সেগুলো নোংরা ও ধুলোবালি যুক্ত হওয়ায় ব্যবহারের উপযুক্ত নয়। ফলে লাইফ জ্যাকেট না পরেই নৌ-ভ্রমণ করছেন তারা। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা থেকে সপরিবার বেড়াতে এসেছিলেন মাজেদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বলেন, আমরা জানতাম না নৌকায় চাপলে লাইফ জ্যাকেট পরার নিয়ম রয়েছে। যারা এর দায়িত্বে রয়েছেন, তারাও এ ব্যাপারে সতর্ক করেননি। তাই জ্যাকেট ছাড়ায় নৌকায় ঘুরলাম।
পদ্মার পাড়ের লালন শাহ মুক্ত মঞ্চ এলাকায় ঘুরতে আসা শ্যামল দেবনাথ বলেন, নৌকা নির্বাচনের ক্ষেত্রে যাত্রীদের সচেতন হওয়া উচিত। যে নৌকায় করে নদীতে ভ্রমণ করতে যাচ্ছি জীবনের নিরাপত্তায় ওই নৌকায় লাইফ জ্যাকেট আছে কিনা সেটাও আমাদের দেখা প্রয়োজন।
তবে নৌ-চালকরা দোষ চাপাচ্ছেন যাত্রীদের ওপর। নৌ-চালক রুবেল বলেন, পদ্মার পাড়ে বেড়াতে এলে সবাই ভালো কাপড় পরিধান করে আসেন, সেজন্য তারা লাইফ জ্যাকেট পরতে চায় না। আমাদের নৌকায় লাইফ জ্যাকেট থাকে সবসময়।
রাজশাহী মহানগর নৌ-পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী মাসুদ বলেন, নদীতে নৌকা ভ্রমণে লাইফ জ্যাকেট বাধ্যতামূলক। যাত্রীদের লাইফ জ্যাকেট না পরিয়ে নৌকায় ওঠানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। কিছুদিন আগেও কোনো নৌকাতেই লাইফ জ্যাকেট ছিলো না। আমরা নৌ-পুলিশই সর্বপ্রথম এই লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থা করেছি। সব নৌকায় লাইফ জ্যাকেট থাকা নিশ্চিত করতে এখনও আমরা কাজ করছি।
খবর কৃতজ্ঞতাঃ দৈনিক সানশাইন