দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা ‘বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর’। দুর্লভ ঐতিহ্যের ধারক এই জাদুঘরটি দুষ্প্রাপ্য সব প্রত্নসম্পদ নিয়ে শতবর্ষ পেরিয়ে আজও স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। দেশের একমাত্র গবেষণা জাদুঘরটি যুগের পর যুগ ধরে প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা এই জাদুঘরে উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলের পাল, সেন, মৌর্য ও গুপ্ত আমলসহ হাজার হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন সংরক্ষিত করে রাখা আছে।
জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠায় নাটোরের দিঘাপাতিয়া রাজপরিবারের জমিদার শরৎ কুমার রায়, আইনজীবী অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এবং রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রামপ্রসাদ চন্দ্রের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁরা বাংলার ঐতিহ্য, নিদর্শন সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য ‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি’ গঠন করেন। একই বছর তাঁরা রাজশাহীর বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান চালিয়ে ৩২টি দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন সংগ্রহ করেন। এই নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করার জন্য শরৎ কুমার রায়ের দান করা জমিতে জাদুঘরটির নিজস্ব ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। নির্মাণ শেষ হয় ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে। বাংলার তৎকালীন গভর্নর কারমাইকেল জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন।
১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা জাদুঘর অকস্মাৎ এতে সংরক্ষিত সব নিদর্শন দাবি করে বসে। তৎকালীন গভর্নর কারমাইকেলের প্রচেষ্টায় ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি জারিকৃত একটি সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বরেন্দ্র জাদুঘরকে এর নিদর্শন সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ব্যাপারে স্বাধিকার প্রদান করা হয়।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের খনন কাজ শুরু করে। পরে বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির একক প্রচেষ্টায় পাহাড়পুর থেকে ২৫৬টি নিদর্শন আবিস্কৃত হয়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পরে জাদুঘরটির অস্তিত্ব নিয়ে সংকট দেখা দেয়। ১৯৪৯ থেকে ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জাদুঘর ভবনটির অর্ধেকাংশ মেডিকেল স্কুল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে জাদুঘরটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে ওই বছরের ১০ অক্টোবর এর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধিগ্রহণ করে। জাদুঘরটির পরিদর্শকদের মধ্যে রয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুসহ বিখ্যাত ব্যক্তিরা।
বরেন্দ্র জাদুঘরের নিদর্শনসমূহ:
বরেন্দ্র জাদুঘরে প্রায় ১৭ হাজারেরও অধিক নিদর্শন বা দুর্লভ সংগ্রহ রয়েছে। রয়েছে পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। এগুলোর অধিকাংশ সংস্কৃত, প্রাকৃত ও আদি বাংলা ভাষায় রচিত। এর মধ্যে ৩ হাজার ৯০০টি সংস্কৃত আর ১ হাজার ৭০০টি বাংলা। সবচেয়ে বেশি আলোচিত ১২৭৩ খ্রিষ্টাব্দ এবং ত্রয়োদশ শতকের কোনো এক সময়ে তালপাতায় লিখিত ও রঙিন চিত্রকর্ম দ্বারা শোভিত দুটি পুঁথি। নাম ‘অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে অতি অনুসরণীয় ও সম্মানিত গ্রন্থ ‘অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’। আট হাজার লাইনে লেখা একটি পুঁথিতে ছয়টি ও অপরটির ৪৯টি পাতায় দেবদেবীর ৪৯টি রঙিন ছবি স্থান পেয়েছে। ছবিগুলোর রং-রেখা হাজার বছর পরও অটুট রয়েছে। বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা পুঁথির চিত্র বাংলার প্রাচীন চিত্রশিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এ ধরনের পাণ্ডুলিপি বা পাণ্ডুলিপির খণ্ডাংশ বাংলাদেশের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে নেই। পাল যুগ থেকে মুসলিম যুগ পর্যন্ত সময় পরিধিতে অঙ্কিত চিত্রকর্ম, নূরজাহানের বাবা ইমাদ উদ দৌলার অঙ্কিত চিত্র এখানে রয়েছে। এই জাদুঘরে ১২ হাজার গ্রন্থ সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থশালা রয়েছে।
জাদুঘরের সংগ্রহশালায় আরও রয়েছে সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শন, মহেনজোদারো সভ্যতার প্রত্নতত্ত্ব, পাথরের মূর্তি, একাদশ শতকে নির্মিত বুদ্ধ মূর্তি, ভৈরবের মাথা, গঙ্গা মূর্তি, মোঘল আমলের রৌপ্য মুদ্রা, গুপ্ত সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের গোলাকার স্বর্ণমুদ্রা, সম্রাট শাহজাহানের গোলাকার রৌপ্য মুদ্রা প্রভৃতি।
জাদুঘরটিকে ৭টি প্রদর্শন কোষ্ঠে ভাগ করা হয়েছে।
প্রথম প্রদর্শন কোষ্ঠে নওগাঁর পাহাড়পুর থেকে উদ্ধারকৃত ২৫৬টি ঐতিহাসিক সামগ্রী রয়েছে।
দ্বিতীয় প্রদর্শন কোষ্ঠে আছে হিন্দু ও বৌদ্ধদের তৈরি কাঠ ও পাথরের নানা ভাস্কর্য।
তৃতীয় ও চতুর্থ প্রদর্শন কোষ্ঠে রয়েছে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি।
পঞ্চম প্রদর্শন কোষ্ঠে আছে বৌদ্ধমূর্তি।
ষষ্ঠ প্রদর্শন কোষ্ঠে রয়েছে বিভিন্ন ভাষায় লিখিত পাথরের খণ্ড।
সপ্তম প্রদর্শন কোষ্ঠে সংরক্ষিত আছে বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিদর্শনগুলো।
সময়সূচি:
দেশের একমাত্র গবেষণা জাদুঘরটি ১৯৬৪ সাল থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। শনিবার থেকে বুধবার বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। বৃহস্পতি, শুক্রবার এবং বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষিত ছুটির দিনগুলোতে জাদুঘরটি বন্ধ থাকে। জাদুঘর দেখার ফি বা দর্শনী ১০ টাকা। তবে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের লাগবে না। এ ছাড়া স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা এলে পরিচালক অর্ধেক দর্শনীর বিনিময়ে প্রদর্শনী দেখার সুযোগ করে দিতে পারেন।
কীভাবে যাবেন:
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর রাজশাহী শহরেই অবস্থিত। রাজশাহীতে আসার পর আপনার সুবিধামত যানবাহনে এই জাদুঘরে যেতে পারবেন। রাজশাহী মহানগরের প্রাণকেন্দ্র হেতেমখাঁ, রাজশাহী কলেজের পাশেই অবস্থিত প্রাচীন সংগ্রহশালা বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর।
প্রতিদিন শত শত বিদ্যার্থী, পর্যটক এবং জ্ঞানান্বেষীগণ এই প্রাচীন জাদুঘরটির বিশাল ও বৈচিত্রময় সংগ্রহ দেখে মুগ্ধ হন। প্রিয় পাঠক, শতবর্ষী দুর্লভ ঐতিহ্যের ধারক এই জাদুঘরটি আপনিও সপরিবারে ঘুরে দেখতে পারেন!