প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য এবং ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা জাতীয় সংসদে বলেছেন, যমুনা নদীতে পৃথক রেল সেতু ও দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ এখন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি দীর্ঘ দিন থেকে সংসদে এই দাবি জানিয়ে আসছি। এখন এ দাবি বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি। বৃহস্পতিবার বিকেলে বাজেটের ওপর বক্তৃতা প্রদানকালে তিনি সংসদে এই দাবি জানান।
ফজলে হোসেন বাদশা উল্লেখ করে বলেন, আমি গত তিন বছর যাবৎ এই পার্লামেন্টে বলেছি, বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে আরেকটি পৃথক রেলসেতু করা হোক। এই রেলসেতু আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। এটা আমরা বাজেটে দেখি, কিন্তু বাস্তবে করা হয় না। পদ্মা সেতু হলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের সমাধান হবে। ঠিক একইভাবে উত্তরাঞ্চলের মানুষের জন্য পৃথক রেল সেতু ও দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু সেতু তৈরি অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, আজকে ঢাকা শহরে জীবিত মাছ পাওয়া যায়, এই মাছ উত্তরাঞ্চল থেকে কৃষকরা যে কী কষ্ট করে আনেন সেটা আপনাদের দেখতে হবে। অথচ এই সমস্যার সমাধানের জন্য কোনো বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না।
বাদশা বলেন, আমরা চাল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আম-লিচু উৎপাদনে সপ্তম, আলু উৎপাদনে অষ্টম এবং মাছ উৎপাদনেও আমরা বিশ্বে একটা জায়গা করে নিয়েছি। তাই কৃষকদের স্বার্থ সবার আগে দেখতে হবে।
ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, রাজশাহী শহরকে বলা হয় রেশম নগরী। সেই রেশম শিল্প নাকি লোকসানে চলে। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, এটি ঠিক নয়। গত এক বছরে আমরা রেশম শিল্পকে চালু করেছি। এখন সেই রেশম শিল্পে আবার নতুন করে বিনিয়োগ প্রয়োজন। নতুনভাবে বিনিয়োগ করে রাজশাহীকে প্রকৃতপক্ষে রেশম নগরীতে পরিণত করার দাবি জানাচ্ছি।
ফজলে হোসেন বাদশা বাজেট বক্তৃতার শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এই সংসদে গত ১০টা বাজেট দেখেছি সাবেক অর্থমন্ত্রীর আমলে। সেই বাজেটগুলোর একেটি শিরোনাম থাকত। প্রতিবছরই শিরোনাম পাল্টে যেত। এই শিরোনাম দিয়ে কী বোঝানো হয়, বাজেটের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝানো হয়, নাকি বাজেটের অর্থনীতির দর্শন বোঝানো হয়, সেটা আমি বুঝি না। কিন্তু শিরোনাম একটা থাকত।
এবারও একটা শিরোনাম এসেছে। সেটা হলো, ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ’। আমি প্রথমেই বলতে চাই, এই বাজেট যখন বাস্তবায়িত হবে তখন জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী এসে যাবে। আমি বরং বলতে চাই, এই বাজেটের শিরোনাম পাল্টে রাখা হোক, ‘সমৃদ্ধ স্বাধীনতার আদর্শের পদযাত্রায়’। আমি আমার প্রস্তাব আকারে বাজেটে উপস্থাপন করছি।
বাদশা বলেন, স্বাধীনতার আদর্শের একটা পদযাত্রা শুরু হোক। কারণ, কিছু দিন পরই আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হবে। অতএব, আমাদের পদযাত্রা যেন স্বাধীনতার আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা দরকার।
একইসঙ্গে আমি বলতে চাই, অতীতে যে সমস্ত বাজেট আমরা উপস্থাপন করেছি, এটা তারই ধারাবাহিকতা। প্রবৃদ্ধি কীভাবে বাড়ানো যায় সেই দিকই আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল।
তাই প্রস্তাবিত বাজেটে যদি কোনো মূল্যায়ন করতে হয় তাহলে তেমন কিছু মূল্যায়ন করার নেই। কারণ এটা বর্তমান সরকারের উন্নয়ন দর্শন, নীতি ও কর্মসূচির ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই প্রণয়ন করা হয়েছে। মূলত প্রবৃদ্ধিনির্ভর উন্নয়ন মডেলকে সামনে রেখে গত ১০ বছর ধরে যে ধরনের বাজেট প্রণীত হচ্ছে এটা তারই ধারাবাহিকতা।
তবে বাজেট বক্তৃতায় প্রবৃদ্ধিনির্ভর উন্নয়ন মডেলের কঠোর সমালোচনা করেন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি বলেন, বিগত পাঁচ বছরে আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ঘটেছে দ্রুত। কিন্তু উপযুক্ত নীতি, কর্মসূচি সংস্কারের অনুপস্থিতি দুটি বড় ধরনের সংকটের জন্ম দিয়েছে। এক, ক্রমবর্ধমান আয় এবং সম্পদের বৈষম্য এবং দ্বিতীয় হচ্ছে, বর্ধিত গুণগত মানসম্পন্ন কর্মসংস্থানের অভাব। প্রবৃদ্ধিনির্ভর উন্নয়ন দর্শন ও মডেলের নানা সীমাবদ্ধতা আছে।
বাদশা বলেন, আমাদের দেশে এই দর্শনে বিপুল উদ্যোগে বাছবিচারহীনভাবে ভৌতঅবকাঠামো গড়ে তোলা গচ্ছে। এতে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়ছে।
অন্যদিকে এই মডেলটা দাঁড়িয়ে আছে এই প্রযুক্তির ওপর যে, বিপুল বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে আপনা-আপনিই কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, যার ফলে উন্নয়ন চুইয়ে পড়বে এবং তা থেকে মানুষ লাভবান হবে। এই তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে মডেলটা প্রয়োগ করা হচ্ছে। আমরা গত এক দশক দেখছি, এই যুক্তি কাজে আসেনি। বাজেটে এই বাস্তবতার কোনো স্বীকৃতি নেই। যদি থাকত, তাহলে এই নীতি কার্যকর হতো।
বাদশা বলেন, এই মডেলটা বাংলাদেশে নতুন না। পৃথিবীর অনেক দেশে এটা আছে। এই উদার নীতিবাদী অর্থনীতি আধিপাত্যের বিস্তার ঘটায়। আমাদের দেশেও কথা এসেছে যে, পাঁচ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের সম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে। যে অর্থনীতিবিদরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তারা বলছেন- এই দৃষ্টিভঙ্গি অচল হয়ে গেছে। এর থেকে আমেরিকাকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং এই নীতি এখনই কবর দিতে হবে। এটা আমেরিকার অর্থনীতিবিদদের মধ্যে চরম বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। যে অর্থনৈতিক নীতি ফেলে দেয়ার কথা এখন বিশ্বে আলোচিত হচ্ছে, ইউরোপ সরে আসছে, সেখানে আমরা এই রাস্তা কেন ধরলাম তার কারণ আমি খুঁজে পাই না।
ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ফজলে হোসেন বাদশা আরও বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বহুবার বাংলাদেশকে একটি কল্যাণমুখী, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলবেন বলে এই পার্লামেন্টে বক্তব্য রেখেছেন। সেই নীতি কী করে বাজেটে হারিয়ে গেল সেটা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। তিনি বলেন, যখন আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করব, তখন বঙ্গবন্ধুকে ভুলে গিয়ে আমরা এমন একটা নীতি গ্রহণ করব যে আমাদের দেশ আমেরিকা হয়ে যাবে, কানাডা হয়ে যাবে, এটা একটা ভ্রান্ত নীতি। এর সঙ্গে আমরা কখনোই একমত হতে পারি না।
প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে সমালোচনা করে বাদশা বলেন, কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদন নিয়ে তোলপাড় হয়ে গেলো। কিন্তু এই বিশেষ অবদান রাখা সেই কৃষকদের কীভাবে আমরা বাঁচিয়ে রাখব, তাদের নায্যমূল্য কীভাবে নিশ্চিত করব, সেটা বাজেটে সম্পৃক্ত হলো না। এটা আমাদের জন্য খুব দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। এখনও আমাদের খাদ্যমন্ত্রী, আমার প্রতিবেশী, আমার এলাকার মানুষ বললেন, আমাদের ওখানে ক্ষেত-মজুর পাওয়া যাচ্ছে না।
কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, এটা উন্নয়নের লক্ষণ। কিন্তু একজন ক্ষেত-মজুর ধান কেটে ৪৫০ টাকা পায়, আর একজন রিকশাচালক ঢাকা শহরে রিকশা চালিয়ে ৯০০ টাকা পায় সেই হিসাবটা কিন্তু করলেন না। তাহলে আজ যদি ক্ষেত-মজুর না থাকে, তাদের যদি গ্রামীণ কৃষির সঙ্গে ধরে রাখতে না পারেন তাহলে কৃষি কীভাবে চলবে সেটা আমাদের ভেবে দেখা দরকার।
বাদশা বলেন, আমাদের খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন- প্যাডি সাইলো করতে হবে। এটা একটা ইতিবাচক প্রস্তাব। আমি মনে করি, প্যাডি সাইলো করতে হবে। এটা সরকার করতে না পারলে পিপিতে করা হোক। খাদ্য মজুত করা হোক। কৃষকরা মধ্যস্বত্বভোগী এবং লুটেরাদের অতিক্রম করে প্যাডি সাইলো পর্যন্ত যেতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
কৃষকদের জন্য বছরে সরকারি উদ্যোগে ১৫০ দিনের কাজের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের ক্ষেত-মজুরদের গ্রামে কাজ কতদিন থাকে সেটা হিসাব করা দরকার। ক্ষেত-মজুররা ৪০ দিন কাজ পায় গ্রামে। আর বাকি দিন তাদের অন্য কাজই করতে হয় কৃষির বাইরে এসে। আমি মনে করি, ক্ষেত-মজুরদের জন্য ১৫০ দিনের কাজ যদি নিশ্চয়তা দেয়া যায় তাহলে তারা কৃষির সাথে থাকতে পারবে। তাই এটা করা দরকার।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, আমাদের বাজেটে বলা হয়েছে তরুণরা হচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ, উন্নয়নের ভবিষৎ। এখানে পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে ফোর্থ ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল রেভুলেশনের কথা বলা হয়েছে। যেটা আজকে সুপার টেকনোলজি পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে। তাহলে এই তিন কোটি তরুণ প্রজন্মকে যদি কাজে লাগাতে হয় তাহলে আমাদের সামনে দুটো প্রশ্ন জড়িত রয়েছে।
এর একটি হলো- তিন কোটি তরুণকে যে কাজে লাগাবো বছরে তার সংখ্যা কত হবে? এটি বাজেটে থাকা দরকার ছিলো। ২০৩০ সালে তিন কোটি তরুণের কর্মসংস্থান হবে তাহলে এই বাজেট কতজনের কর্মসংস্থান দেবে সেটারও কোন উল্লেখ নেই। ২০৩০ সালে আরও তিন কোটি তরুণ কর্মসংস্থানের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকবে। তখন তাদের সমস্যার সমাধান কে করবে সেই প্রশ্নও রাখেন রাজশাহীর এই সংসদ সদস্য। এটা ভেবে দেখা দরকার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ফোর্থ রেভুলেশনকে যদি সত্যিই অ্যাড্রেস করে থাকি তাহলে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যে বাজেট দেয়া হয়েছে তা আরও দেড়গুন বাড়িয়ে দেয়া দরকার। যদি না বাড়িয়ে দেওয়া হয় তাহলে উন্নত বা বিশ্বমানের শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যাবে না। বিশ্ব অগ্রগতির কোন কিছুই ছুঁয়ে দেখা যাবে না। এটা আমাদের স্বপ্নের মধ্যেই থেকে যাবে। যা কোন দিন বাস্তবায়ন হবে না। তাই এই বিষয়টা বাজেটে ভেবে দেখা দরকার। এ সময় ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের সমালোচনা করে বাদশা বলেন, আমাদের দেশে অতি ধনী সৃষ্টি হচ্ছে এবং তাদের একটা সুবিধা দেয়া হচ্ছে। বাজেটে সবচেয়ে সম্মান পেয়েছেন ধনীরা। আর যাদেরকে ওনারা দেখতে পাননি, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত এবং বাজেটে যাদের মোটেও গুরুত্ব দেয়া হয়নি তারা হচ্ছেন গরীব, তারা উপেক্ষিত। তার মধ্যে আদিবাসী আছে, চরের মানুষ আছে। চরে এক কোটি মসানুষ বাস করে। আপনি গত দু’বছরের বাজেট খুঁজে দেখেন, চরের মানুষের জন্য কোনো বাজেট নেই। ধনী মানুষদেরকে খাতির করে যে বাজেট করা হচ্ছে, ৯৫ ভাগ মানুষকে যে উপেক্ষিত করা হচ্ছে, সেটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নেও ছিল না, বঙ্গবন্ধুরও স্বপ্নেও ছিল না। এই বাজেট দর্শন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলেও আমি মনে করি না।
খবর কৃতজ্ঞতাঃ Daily Sunshine