আমে প্রতি বছরই রাজশাহী অঞ্চলে শতকোটি টাকার বাণিজ্য হয়। কিন্তু এবারের বাণিজ্য মন্দা। এক যুগের মধ্যে এবারই আমের দাম তলানিতে। মাত্র ৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে একমণ আম। সে হিসাবে প্রতি কেজি আমের দাম পড়ছে সাড়ে ১২ টাকা। দাম না পাওয়ায় গাছেই পাকছে চাষিদের আম। লাভের আশা ছেড়েই দিয়েছে এ অঞ্চলের ছোট-বড় চাষি। এবার চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছেন তারা।
রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ বছরের আম ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, গত ২০ মে থেকে শুরু হয় আম পাড়ার কর্মযজ্ঞ। ওই দিন থেকে গুটি ও গোপাল ভোগ জাতের আম বাজারে ওঠার কথা ছিলো। কিন্তু এবার বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে পাকেনি গুটি ও গোপাল ভোগ। ১ জুন থেকে হিমসাগর, ক্ষিরসাপাত ও লক্ষণভোগ এবং ৬ জুন থেকে ল্যাংড়া বাজারে ওঠার কথা ছিলো। না পাকায় বাজারে ওঠেনি এসব জাতের আমও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০ মে থেকে ১০ জুন আম পাকার জন্য যে তাপমাত্রার প্রয়োজন ছিলো, তা ছিল না। ফলে কমসংখ্যক চাষিই ওই সময়ে গাছ থেকে আম নামাতে পেরেছেন। আবার ১০ জুনের পর থেকে তাপমাত্র বেড়ে যায়। সপ্তাহ জুড়ে তাপমাত্রার পারদ ওঠানামা করে ৩৫-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ভ্যাপসা গরমে একসঙ্গে পেকে যায় সবজাতের আম। আর রোজা থাকায় আমের বিক্রি কমে যায়। মৌসুমের শেষ আশ্বিনা জাতের আম ছাড়া প্রায় সব জাতেরই আম চলে এসেছে বাজারে। আগামী ১ জুলাই বাজারে উঠবে আশ্বিনা।
এদিকে, ভরা মৌসুমে ঈদের কারণে আম চাষিরা প্রয়োজনীয় শ্রমিক পাননি গাছ থেকে আম নামানোর। বেশি পারিশ্রমিকে শ্রমিক পেলেও আম নামিয়ে নিয়ে গন্তব্যে পাঠাতে পারেননি। কারণ ঈদের টানা কয়েকদিন পরিবহন সেবা বন্ধ ছিল। আর এতেই কপাল পোড়ে চাষিদের।
নওগাঁর পোরশা উপজেলার বড়রনাইল এলাকার আম চাষি নাজমুল হোসাইন বলেন, আম পাকার আগ মুর্হূর্তে ঝড়ের কবলে পড়ে আম বাগানগুলো। এতে বেশির ভাগ আম পড়ে যায়। যেটুকু আম ছিলো তা বিক্রির মত ক্রেতা পাননি। শ্রমিক খরচা না ওঠায় আম নামাতেই পারেননি গাছ থেকে।
তিনি আরও বলেন, গত মৌসুমে গাছ থেকেই হিমসাগর ১৬০০-১৮০০ টাকা, ল্যাংড়া এবং ক্ষিরসাপাত ১৬০০-১৮০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এবার দাম অর্ধেকেও কম। তারপরও ক্রেতা নেই। চাষ-বাসের খরচই উঠবে না এবার। রাজশাহী জেলার সবচেয়ে বড় আমের মোকাম পুঠিয়ার বানেশ্বর হাট। এ অঞ্চলে গোপালভোগ আম রয়েছে প্রায় শেষ পর্যায়ে। তারপরও এ মোকামে আমের দাম গত কয়েক মৌসুমের মধ্যে সবচেয়ে কম।
অত্যন্ত সুমিষ্ট এ জাতের আম ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, হিমসাগর এক হাজার থেকে ১১০০ টাকা এবং ল্যাংড়া ১১০০-১২০০ টাকা এবং ক্ষিরসাপাত ১২০০-১৩০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। আর বিভিন্ন জাতের গুটি আমের দাম মণ প্রতি মাত্র ৫০০ টাকা।
এ বিষয়ে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক দেব দুলাল ঢালি বলেন, প্রচণ্ড গরম পড়ায় দ্রুত আম পেকে যাওয়ায় কিছুটা সমস্যা হয়েছিল। এতে বিপাকে পড়েন চাষিরা। আম মূলত বিরুপ প্রকৃতির ফসল। প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠলে চাষিদের মুখে হাসি ফোটায় ফলের রাজা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, কয়েক বছর ধরেই দেশে আমের উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে আমের উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ১০ লাখ ১৮ হাজার টন। পরের অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১ লাখ ৬১ হাজার ৬৮৫ টনে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে আম উৎপাদন হয় সাড়ে ১২ লাখ টন। তবে চলতি অর্থবছর তা ছাড়িয়ে যাবে ১৪ লাখ টন। এর মধ্যে রাজশাহীতেই তিন লাখ টনের উপর উৎপাদন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে আম উৎপাদন হচ্ছে প্রায় এক লাখ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবাদ হচ্ছে বৃহত্তর রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। গত ৭ বছরে এ অঞ্চলে আমের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। গত বছর এ অঞ্চলের ১৭ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে।
সেখানে উৎপাদন হয়েছে এক লাখ ৮১ হাজার ১০৭ টন। এর আগে ২০১৬ সালে রাজশাহীতে ১৬ হাজার ৫৮৩ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে রাজশাহীর আম যাচ্ছে বিশ্ববাজারে।
খবর কৃতজ্ঞতাঃ ডেইলি সানশাইন