দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না করা ও যথাযথ তদারকির অভাবে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ‘রেলট্র্যাক’ (লাইন) ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে হরহামেশায় ঘটছে লাইনচ্যুতির ঘটনা। একই কারণে গতি আসছে না ট্রেন চলাচলেও। ক্রটিপূর্ণ ট্র্যাকের কারণে রেলযাত্রীরাও শঙ্কায় থাকেন পশ্চিমাঞ্চল রেলরুটে।
সর্বশেষ ১১ মার্চ রাতে রাজবাড়ী থেকে ছেড়ে আসা রাজশাহীমুখি ‘মধুমতি এক্সপ্রেস’ নামের একটি ট্রেন রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের অদূরে হরিয়ান স্টেশনের কাছে এসে হঠাৎ লাইনচ্যুত হয়। ট্রেনটিতে থাকা যাত্রীরা প্রাণভয়ে আঁতকে ওঠেন। আশপাশের মানুষ সেখানে ভিড় জমান। লাইনের দুই ধারে গর্ত থাকলেও সৌভাগ্যক্রমে ট্রেনটি সেদিন লাইনের ওপরেই আটকে থাকে। ফলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। এতে কোন হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও লাইনচ্যুতির কারণে সারাদেশের সঙ্গে রাজশাহীর রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ রুটে প্রায় লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটলেও ট্র্যাক মেরামতে যথযথ পদক্ষেপ নেয় না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এ রুটে কিছুদিন পর পরই ট্রেন লাইনচ্যূতির ঘটনা ঘটে।
সরেজমিন এ রেল রুটের হরিয়ান স্টেশনের কাছে গিয়ে দেখা যায় লাইনের ভগ্নদশা। সেখানে সমান্তরাল তিনটি লাইনের মধ্যে ৩ নম্বর লাইনটি চলাচলের অনুপযোগী হওয়া সত্বেও তা ব্যবহার করা হচ্ছে। দুর্ঘটনার দিন সেই লাইন দিয়েই চালানো হয় ট্রেনটি। সেই ট্র্যাকে দেখা যায়, পুরাতন কাঠের স্লিপারগুলোকে সারিবদ্ধ করে ধরে রাখতে ৫৪ নম্বর রেলব্রিজের ওপর স্লিপারগুলোতে প্রযুক্তিগত পদ্ধতির বাইরে বাঁশের বাতা ব্যবহার করা হয়েছে। আর ৬৮০ মিটার সংস্কারাধীন দুই নম্বর লাইনটির মেরামত কাজ শেষ না হতেই তড়িঘড়ি করে উদ্বোধন করা হয়েছে।
রাজশাহীর অদুরে হরিয়ান স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, এখানকার লাইনের দুই ধারেই রয়েছে বিরাট গর্ত। নিরাপত্তা বেস্টনী ছাড়ায় ট্রেন লাইনগুলো গড়ে উঠেছে। স্টেশনের তিনটি রেল লাইনের মধ্যে ২ নম্বর লাইনে মেরামতের কাজ করা হচ্ছে। সংস্কারাধীন এই লাইনটিতে এখনো পাথর বসানো হয়নি। কনক্রিট স্লিপারের সঙ্গে লাইনের সংযোগ ধরে রাখার জন্য পর্যাপ্ত ক্লিপ বসানো হয় নি। এক ও তিন নম্বর লাইনের পাত ঘেঁষে বিভিন্নস্থানে ফেলে রাখা হয়েছে পাথর ও মাটির স্তুপ। ৩ নম্বর লাইনের পুরোটা জুড়ে গজিয়েছে ঘাস। অযত্ন ও অবহেলায় লাইনটির এখন বেহাল দশা। তাও তার ওপর দিয়ে চলাচল করছে আন্ত:নগরসহ মালবাহী ট্রেন। লাইনে ঘাস জন্মানোর কারণে দুরে থেকে বোঝা যায়না আদৌ লাইনে পাত আছে কিনা। পাতের নিচের স্লিপারগুলো মাটি ও ঘাসে ঢাকা পড়েছে। দেখেই মনে হবে বহুদিন থেকেই লাইনটির যত্ন নেয়া হয়নি। তবে দুর্ঘটনার কারণে লাইনে যে ত্রুটি হয়েছে তা মেরামতের জন্য তড়িঘড়ি করে কাজ শুরু করা হয়েছে।
স্টেশন থেকে প্রায় তিনশ গজ পূর্বে ৫৪ নম্বর ব্রিজের কাছে গিয়ে দেখা যায়, ব্রিজটির ওপর লাইনের নিচে ব্যবহৃত কাঠের স্লিপারগুলোতে পেরেক পুতে বাঁশের চিকন বাতা দিয়ে তা আটকে রাখা হয়েছে। ব্রিজটি ব্রিটিশ আমলের তৈরি বলে স্থানীয়রা জানান। তাদের অভিযোগ, এতো ভারি ট্রেনের ভার কখনো এই সামান্য বাঁশের বাতা লোড নিতে পারবে না।
এদিকে গত ১১ মার্চ রাতে ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমাঞ্চল রেলের পক্ষ থেকে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্য ও রেলওয়ে পশ্চিমের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা আব্দুলাহ আল মামুন বলেন, এখানো প্রতিবেদন দাখিল করা হয়নি। বিষয়টির তদন্ত চলছে। দু-এক দিনের মধ্যেই প্রতিবেদন দেয়া সম্ভব হবে।
এদিকে হরিয়ানের স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কালাম অভিযোগ করে বলেন, ১১ তারিখ রাতে লাইনচ্যুতির শিকার ট্রেনটি ঝুঁকিপূর্ণ লাইন দিয়েই আসছিলো। ট্রেন লাইনের পাত ঘেষে কিছুদুর পর পর পাথর ফেলে রাখায় সেই পাথরের সঙ্গে ট্রেনের চাকা স্লিপ করে লাইনচ্যূত হয়। এছাড়া এই লাইনটিও ঢেউয়ের মতো উঁচুনিচু হয়ে আছে বহুদিন থেকে। এক নম্বর লাইনেও একই ভাবে ফেলে রাখা হয়েছে মাটির স্তুপ। দুর্ঘটনার দিন যদি কোন কারণে ট্রেনটি গর্তের দিকে হেলে পড়তো তবে বড় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারতো।
একই অভিযোগ করে আসলাম বাবু নামের স্থানীয় বাসিন্দা জানান, দুই নম্বর লাইন মেরামতের কাজ চলছে। এখনো পাথর ফেলা বাঁকি রয়েছে। এছাড়া স্লিপার ও লাইনের বাঁধনের কাজও শেষ হয়নি। এতো কাজ বাঁকি থাকলেও লাইনটা উদ্বোধন করা হয়েছে। ৫৪ নম্বর ব্রিজের দিকে দেখিয়ে তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন, বাঁশের বাতা দিয়ে লাইন আটকানো রয়েছে।
লাইনের সংস্কার কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বিএম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী এমএ মালেকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে ওই প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার ফারুক হোসেন বলেন, দুই নম্বর লাইনের কাজ এখনো শেষ হয়নি। তবে ১১ তারিখ এটি ট্রেন চলাচলের জন্য উদ্বোধন করা হয়েছে।
জানা গেছে মূল ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বিএম ইঞ্জিনিয়ারিং তাদের কাজটি তদারকির জন্য সাব ঠিকাদার হিসেবে মেসার্স প্রধান এন্টারপ্রাইজকে দিয়েছে। প্রধান এন্টারপ্রাইজের কাজে নিয়োজিত নিতাই বাবু আয্য বলেন, আমার দুই নম্বর লাইনে কাজ করছি। লাইনের কাজ এখনো বাঁকি রয়েছে। ট্রেনের চাপ থাকায় লাইন ইতিমধ্যে উদ্বোধন করা হয়েছে।
এদিকে হরিয়ানসহ এ অঞ্চলের রেল রুটের দুর্দশার কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমের প্রধান প্রকৌশলী আফজাল হোসেন বলেন, হরিয়ান স্টেশনের ৩ নম্বর লইনটি যাত্রীবাহী ট্রেনের জন্য উপযুক্ত নয়। এই লাইনটি পর্যায়ক্রমে সংস্কার করে হবে। আর ২ নম্বর লাইনটি সংস্কারের কাজ করা হচ্ছে। লাইনটিতে এখনো স্লিপার ও পাথর বসানোর কাজ শেষ হয়নি। কাজ শেষ না হলেও ট্রেন ক্রসিংএর সুবিধার্থে লাইনটি লিংক দেয়া হয়েছে মাত্র।
খবর কৃতজ্ঞতাঃ ডেইলি সানশাইন