রাজশাহী মহানগরীর বালিয়াপুকুর এলাকার বাবুল হোসেনের তিন বছরের ছোট্ট মিশু নুহা। ২২ দিন থেকে জ¦রে আক্রান্ত। কোনভাবেই জ¦র ভালো হচ্ছে না। চিকিৎসক এন্টিবায়োটিক চিকিৎসা দিয়েছেন। এরপরেও জ¦র ভালো হয়না। আবার করানো হয় রক্ত পরীক্ষা। জানা যায় যেসব এন্টিবায়োটিক ওষুধ দেয়া হয়েছে তা কাজ করছে না। শুধু শিশু নুহা নয়। এমন সমস্যা এখন অনেক রোগির। ছোটখাটো অসুখের কাজ করছে না এন্টিবায়োটিক। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন এন্টিবায়োটিকের যাচ্ছে তাই ব্যবহারের কারণে কার্যক্ষমতা হারাচ্ছে। যা ইতোমধ্যেই চিকিৎসকদের মাঝে ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চিকিৎসকরা জানান, এন্টিবায়োটিক হচ্ছে সেই সব ওষুধ যা ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক বা পরজীবী ধ্বংস করে। আর এই ওষুধ যদি সঠিক নিয়মে প্রয়োগ না করলে এক পর্যায়ে ওই জীবাণু সেই ওষুধের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। এমন পরিস্থিতিকে বলা হয় ‘এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স’। অর্থাৎ যখন ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক এর কার্যকারিতা থাকে না। ফলে সেই ওষুধে আর কোন কাজ হয়না।
বিশ্বে যে হারে নতুন এন্টিবায়োটিক তৈরি করা হচ্ছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হারে বাড়ছে এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স। যার ফলে অদূর ভবিষ্যতে সামান্য হাঁচি-কাশি-জ্বরেও মানুষের মৃত্যু ঝুঁকি হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন চিকিৎসারা।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমানের স্বাক্ষরিত এ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘অপ্রয়োজন, অযৌক্তিভাবে ও অসম্পূর্ণ মেয়াদে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে প্রতিরোধী জীবানুর মাধ্যমে আমাদের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মৃত্যু ঝুকি বাড়ছে। জেনে রাখা ভালো যে, ভাইরাসজনিত সর্দি-কাশি-ডায়রিয়াতে এন্টিবায়োটিক কাজ করে না।’
পরবর্তী প্রজন্মের ব্যবহারের জন্য এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য ৩টি নির্দেশনাও দিয়েছেন ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমান। পরামর্শগুলো হচ্ছে শুধুমাত্র রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন মোতাবেক এন্টিবায়োটিক বিক্রি, সেবন বা গ্রহণ করতে হবে। এন্টিবায়োটিক সেবন বা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রেসক্রিপশনে উল্লেখিত সময় ও নির্দেশনা মেনে চলতে হবে ও শরীরিকভাবে সুন্থ্য অনুভব করলেও প্রেসক্রিপশনের নির্দেশিত এন্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পূর্ণ করতে হবে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) এন্টিবায়োটিকের ব্যবহারের উপরে গবেষনা চালিয়ে কয়েক বছর আগে। গবেষনার ফল থেকে পাওয়া যায়, চিকিৎসকগণ রোগির শরীরের সংক্রমণ বা ইনফেকশন চিকিৎসার জন্য মল, মূত্র, কফ, রক্ত, ক্ষতস্থানের রস বা পুঁজ,গলার লালা, মলদ্বারের লালাসহ শরীরের বিভিন্ন নমুনা জীবানু শনাক্তকরণ ও সংবেদনশীলতা বা কালচার অ্যান্ড সেনসিটিভি পরীক্ষা করতে দিয়ে থাকেন।
পবা ঢাকার তিনটি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আগত রোগিদের বিভিন্ন নমুনার পরীক্ষা পরবর্তী ফলাফল সংগ্রহ করে। সে ফলাফলকে বিশ্লেষণ করে পবা একটি রিপোর্ট দিয়েছে। সমীক্ষায় অন্তর্ভূক্ত নমুনা সংখ্যা ৩০৫। ২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ১৩ মার্চ পর্যন্ত গবেষণাটি চলে। সেই গবেষণায় দেখা যায়। ৫৫ দশমিক ৭০ ভাগ মানুষের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর। ঢাকা শহরে যে রোগজীবানু দ্বারা সংক্রমণ ঘটে তার বিরুদ্ধে ৫৫ দশমিক ৭০ ভাগ অ্যান্টিবায়োটিক কোন কাজ করে না। বর্তমান সময়ে এ পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করেছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছে।
ঢাকার একজন ডেন্টাল চিকিৎসক হৃদিতা রোশনি তার ফেসবুক স্ট্যাটার্সে বলেন, ‘ব্যাক্টেরিয়া যা কিনা খালি চোখে দেখা যায়না, এই ব্যাক্টেরিয়া আপনার চেয়ে বহু গুণ বেশি চালাক এবং তাকে হারাতে রীতিমত মানুষের ঘাম ছুটে যাচ্ছে। এখন আর এন্টিবায়োটিক মানুষের শরীরে কাজ করেনা, কারণ এসব (এন্টিবায়োটিক) আপনি এমন মুড়ি মুড়কির মত খাইছেন যে, ব্যাক্টেরিয়া নিজের প্রতিরোধ নিজেই গড়ে ফেলছে। পরিস্থিতির সাথে নিজেকে (ব্যাক্টেরিয়া) আরো বেশি শক্তিশালী করে ফেলছে।’
ডেন্টাল চিকিৎসক হৃদিতা রোশনি আরো বলেন, এগুলার জন্য দায়ী ফার্মেসীর দোকানদাররা। না শুনে, না বুঝে, যখন তখন এন্টিবায়োটিক খাওয়া এবং সেটার ডোজ কম্পলিট না করা। এমন ভাববেন না যে, আপনি কখনো অনিয়ম করে এন্টিবায়োটিক খাননি তাই আপনার ঝুঁকি নেই, ঘটনাটা এমন না। অন্যের ভুলের কারণে ব্যাক্টেরিয়ার যে পরিবর্তন চলে আসছে, তারপর থেকে যখনই ব্যাকটেরিয়া বংশ বৃদ্ধি করে তখনই নতুন আপডেটেড ভার্সনের ব্যাক্টেরিয়া প্রকৃতিতে চলে আসে আর সেজন্য আপনি নির্দোষ হইলেও এখন আপনার শরীরে সাধারণ এন্টিবায়োটিক কাজ করবেনা। খুবই হাই পাওয়ারের কিছু ওষুধ আর কিছু ওষুধের কম্বিনেশনের কারণে কোনোভাবে সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে। তাও কয়েকদিন পর আর সেটাও সম্ভব হবেনা যদি এমনভাবেই না জেনে, না শুনে, না বুঝে এন্টিবায়োটিক খাওয়া মানুষ বন্ধ না করে।
খবর কৃতজ্ঞতাঃ Daily Sunshine