ঢাকা-রাজশাহী রেলপথে বিরতিহীন আন্ত নগর ট্রেন বনলতা এক্সপ্রেস শুরুতেই যাত্রী হারাচ্ছে। গত ২৭ এপ্রিল বাণিজ্যিকভাবে ট্রেনটি চালু করার পর প্রায় প্রতিদিনই রাজশাহী থেকে ছাড়া ট্রেনটির শোভন চেয়ারের আসনগুলোর প্রায় অর্ধেকই ফাঁকা থাকছে। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল, টিকিটের সঙ্গে বাধ্যতামূলক যে খাবার দেওয়া হচ্ছে, সেটা নিম্নমানের। কিন্তু দাম রাখা হচ্ছে বেশি।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা বনলতা ট্রেনটির যাত্রী, গার্ড, ট্রেন টিকিট এক্সামিনার (টিটিই), অ্যাটেনডেন্ট এমনকি দায়িত্বরত রেল পুলিশ সদস্যদেরও একই কথা।
তাঁদের ভাষ্য, টিকিটের সঙ্গে বাধ্যতামূলক ১৫০ টাকা খাবারের মূল্য জুড়ে দেওয়ায় যাত্রীরা আগ্রহ হারাচ্ছে। কারণ ট্রেনটির বেশির ভাগ যাত্রীই মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির। তারা বলছে, বিরতিহীন বনলতায় সাধারণ শোভন চেয়ারের টিকিটের মূল্য খাবারের দামসহ ৫২৫ টাকা। অন্যদিকে আন্ত নগর সিল্কসিটিতে এই আসনের টিকিটের দাম ৩৪০ টাকা। বনলতায় ভ্রমণে দেড় ঘণ্টা সময় বাঁচে। কিন্তু এ সময় বাঁচাতে গিয়ে ১৮৫ টাকা গচ্চা দিতে চাচ্ছে না এসব যাত্রী।
ট্রেনটি রাজশাহী থেকে সকাল ৭টায় ছেড়ে ঢাকা পৌঁছে সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে। ঢাকা থেকে দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে ছেড়ে রাজশাহী পৌঁছে সন্ধ্যা ৬টায়। ট্রেনটিতে খাবার সরবরাহ করছে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রথম নিজস্ব ক্যাটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম সার্ভিসেস (বিআরসিটিএস)। খাবারের মূল্য ১৫০ টাকাসহ শোভন চেয়ারের টিকিট ৫২৫ টাকা এবং এসি চেয়ারের টিকিট ৮৭৫ টাকা। অন্যদিকে সিল্কসিটিতে রাজশাহী থেকে ঢাকায় পৌঁছতে সময় লাগে ছয় ঘণ্টা।
ট্রেনটির ‘খ’ বগির যাত্রী ছিলেন কালের কণ্ঠের এই প্রতিবেদক। এসি স্নিগ্ধা শ্রেণির বগিটির প্রতিটি আসনই ছিল পূর্ণ। কিন্তু বগিটির সামনের ‘ক’ বগিটিতেই ১১টি আসন ফাঁকা ছিল। এটি ছিল সাধারণ শোভন চেয়ারের বগি। এর পরের বগি এসি স্নিগ্ধা ‘গ’ও ছিল পূর্ণ। কিন্তু পরের ‘ঘ’ শোভন চেয়ারের বগিতে ছিল পাঁচটি আসন ফাঁকা। ওই বগির পরে ‘চ’ বগিটি ছিল পাওয়ার কার। তার পরেই ‘ছ’ বগিতে ৯২টি আসনের ৪১টিই ফাঁকা ছিল। এই বগির যাত্রী ছিলেন হাসান নামের একজন। তিনি বলেন, ‘আমাদের মতো মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বাধ্য হয়ে এই ট্রেনে যাচ্ছে। জরুরি প্রয়োজনে যাচ্ছি। দেড় ঘণ্টা সাশ্রয় হবে। কিন্তু এই দেড় ঘন্টা সাশ্রয় করতে গিয়ে ১৮৫ টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে।’
‘ঞ’ বগিতে যেতেই দেখা গেল প্রায় পুরো বগিই ফাঁকা। মাঝের তিনটি আসন একাই দখল করে ঘুমাচ্ছে একটি শিশু। দেখে মনে হলো, পথশিশু। তার পেছনের কয়েকটি চেয়ারে বসে আছে জনাকয়েক যাত্রী। সব মিলিয়ে এ বগিতে যাত্রী ছিল ৩৯ জন। ফাঁকাই ছিল ৫৩টি।
যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বনলতা ট্রেনটির ব্যাপারে রাজশাহীর মানুষের বেশ উচ্চাশা ছিল। ট্রেনটির যাত্রীদের বিপুল অংশই শিক্ষার্থী, যারা ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ বা বড় বড় স্কুলে পড়াশোনা করে। তাদের কথা বিবেচনা করে অন্তত বনলতা ট্রেনের টিকিটের সঙ্গে খাবার বাধ্যতামূলক না করলেই রেল কর্তৃপক্ষ ভালো করত। এটা প্রত্যাহার করা উচিত। তা না হলে ক্রমেই যাত্রী হারাবে ট্রেনটি।
ট্রেনের ‘জ’ বগির শোভন চেয়ারের যাত্রী রাজশাহীর বৈকালী সংঘ স্পোর্টিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক রইচ উদ্দিন বাবু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খাবার বলতে একটা শিঙাড়া, হাফ লিটার পানির বোতল, একটা বার্গার আর এক পিস কেক। সঙ্গে প্যাকেটজাত করা সস। এই খাবারের দাম বড় জোর রাজশাহীতে ৭৫-৮০ টাকা। কিন্তু সেই খাবারের জন্যই টিকিটের সঙ্গে কেটে নেওয়া হচ্ছে ১৫০ টাকা। এটা জোচ্চুরি ছাড়া কিছুই নয়।’ তিনি মনে করেন, যারা গ্যাস্ট্রিক-আলসারের রোগী তারা সকালে এসব খাবার খেয়ে উল্টো বিপদে পড়বে। তাঁর এ সমস্যা থাকায় তিনি খাবার মুখে তোলেননি।
ট্রেনের এসি স্নিগ্ধার যাত্রী আরমান আলী বলেন, ‘ট্রেনে বিকল্প কোনো খাবার নেই। যে কারণে খাই না খাই খাবার নিতে বাধ্য হচ্ছি আমরা। কিন্তু খাবারের বেশির ভাগই কোনো কাজে আসছে না যাত্রীদের। কারণ সকালে বা দুপুরে বার্গার, শিঙাড়া ও কেক অনেকেই পছন্দ করে না।’
বিষয়টি স্বীকার করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ট্রেনে দায়িত্বরত একজন অ্যাটেনডেন্ট কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খাবারের দামের কারণেই বনলতায় শোভন চেয়ারে যাত্রী হচ্ছে না। প্রতিবারই বিপুলসংখ্যক আসন ফাঁকা থাকছে।’
রেলের দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের হিসাব অনুযায়ী, রাজশাহী থেকে ঢাকার উদ্দেশে গতকাল সকালে ছেড়ে আসা বনলতায় ২৪০টি আসন ফাঁকা ছিল। অনেকেই টিকিট কাটার সময় না পেয়ে তড়িঘড়ি করে ট্রেনে ওঠে। পরে জরিমানাসহ তারা টিকিট কাটে। তাই কিছু যাত্রী বাড়তি হয়েছে। না হয়, ৩০০ আসনই ফাঁকা থাকত। ফাঁকা আসনের প্রায় সবই সাধারণ শোভন শ্রেণির।
ট্রেনের অ্যাটেনডেন্ট এস এম এ মালেক জানান, গতকাল সকালে রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা বনলতায় মোট যাত্রী ছিল ৬৬৮ জন। আগের দিন বুধবার সকালে ছিল ৮৪৪ জন।
ট্রেনের টিটিই সুমন হোসেন বলেন, খাবারের মূল্য বাদ দিলে যদি ২৪০ আসন ফাঁকা থাকে, তাহলে ৩৭৫ টাকা টিকিট মূল্য ধরে অন্তত ৯০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে আজ (বৃহস্পতিবার)।
বনলতা এক্সপ্রেসে ১২টি বগিতে মোট যাত্রী আসন ৯২৪টি। এর মধ্যে শোভন চেয়ারের বগি সাতটি, আসনসংখ্যা ৬৬৪টি।
রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনের সুপারিনটেনডেন্ট আমজাদ হোসেন বলেন, সবার চোখ এসি চেয়ারের টিকিটের দিকে। কিন্তু শোভন চেয়ারের টিকিট খুব বেশি বিক্রি হচ্ছে না। এ কারণে প্রায় সব ট্রেনেই আসন ফাঁকা থাকছে।
খবর কৃতজ্ঞতাঃ কালের কণ্ঠ