রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এখন পাখির রাজ্য। সারাদিন মুখর থাকে পাখির কলকাকলিতে। ক্যাম্পাসের জলাশয়গুলোতে ছোট ছোট আসর বসিয়ে আছে শত শত পাখি। তারা কখনো আপন খেয়ালে পানিতে ডুবছে তো ফুড়ুত করে উড়াল দিচ্ছে আকাশে। খোলা আকাশে দু-এক চক্কর দিয়ে আবার নেমে আসছে। খুনসুটি করছে নিজেদের মধ্যে, দিচ্ছে ডুবসাঁতার। কেউ আবার পালকের ভেতর মুখ গুঁজে পোহায় মিষ্টি রোদ।
এই পরিযায়ী পাখিগুলোকে আদর করে সবাই ডাকে অতিথি পাখি! শীতকালে বাংলাদেশের অনেক জায়গায় এই ‘অতিথি’ পাখিদের আনাগোনা দেখা যায়, তার মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সবুজে ঘেরা ক্যাম্পাসও একটি। শীতের এসব অতিথি পাখি দেখতে প্রতিদিন ক্যাম্পাসে আসছে অনেক দর্শনার্থী।
প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে হিমালয়ের উত্তরে প্রচণ্ড শীত নামতে শুরু করে। ফলে উত্তরের শীতপ্রধান অঞ্চল সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, জিনজিয়াংসহ চীনের নানা শীতার্ত এলাকা, নেপাল ও ভারতে প্রচুর তুষারপাত হয়। তুষারপাতের ধকল সইতে না পেরে পাখিরা উষ্ণতার খোঁজে পাড়ি জমায় বিভিন্ন নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে। এ সময় হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি দক্ষিণ এশিয়ার নাতিশীতোষ্ণ দেশ বাংলাদেশে আসে। দেশের যেসব এলাকায় এসব পাখি আসে সেসবের মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম।
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক পাখি লোকগুলোতে আসে সাইবেরিয়া থেকে। বর্তমানে যেসব পাখি দেখা যাচ্ছে সেগুলো এসেছে নেপাল ও ভারতের হিমালয় ও বাংলাদেশের হাওর অঞ্চল থেকে।
দুই ধরনের পাখির আগমন ঘটে এ ক্যাম্পাসে। এক ধরনের পাখি ডাঙায় বা শুকনো স্থানে বা ডালে বসে বিশ্রাম নেয়। আরেক ধরনের পাখি পানিতে থাকে ও বিশ্রাম নেয়। এদের বেশির ভাগই হাঁস জাতীয়।
এ ক্যাম্পাসে যে সব পাখি আসে সেসবের মধ্যে বেশির ভাগ ছোট সরালি। আর বাকি অল্প সংখ্যক অন্য প্রজাতির পাখি। এদের মধ্যে রয়েছে, বড় সরালি, ল্যাঞ্জা হাঁস, খুন্তে হাঁস, ভূতি হাঁস ও ঝুঁটি হাঁস ইত্যাদি। যেহেতু শীত মৌসুমে পরিযায়ী পাখিরা আসে, তাই এসময় নৈস্বর্গীক প্রকৃতির রাবি ক্যাম্পাস অপেক্ষা করতে থাকে তাদের জন্য।
সকালবেলা শীতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে হাঁটতে বেরিয়েছেন অনেকেই। কথা হয় এমনি একজন প্রাতভ্রমণকারী গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী হীরা আক্তার প্রীতির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি মাঝে মাঝে ভোরে বেরিয়ে পড়ি হাঁটতে। কিন্তু পুরো শীতকালে নিয়মিতই বের হই। এই নিয়মিত বেরোনোর মূল কারণ শীতকালে ক্যাম্পাসের স্বর্গীয় পরিবেশ। কুয়াশার চাদর ভেদ করে সবুজ প্রকৃতি দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। আর সাথে পাখির কলকাকলিতে আমার মন ভালো হয়ে যায়। মনে হয় মানুষের ঘুম ভাঙার অনেক আগেই যেন পাখিগুলোর কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়।’
অন্যরকম অনুভূতির কথা জানান শহীদ শামসুজ্জোহা হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ইয়াজিম পলাশ। তিনি বলেন, ‘শীতকালে ঘুম ভাঙে খুব সকালে, নাম না-জানা অসংখ্য পাখির কলকাকলিতে। ঘুম ভাঙার পর জানালা খুলে পাশের জলাশয়ের দিকে তাকাই। মিষ্টি রোদের আলো আর হালকা কুয়াশায় জলাশয়ের স্বচ্ছ জলের ওপর নানা রঙের অতিথি পাখি দেখি। আমি যতবারই দেখি ততবারই মুগ্ধ হই।’
পাখি বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আমিনুজ্জামান মো. সালেহ্ রেজা বলেন, ‘রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস পাখিদের জন্য উপযুক্ত একটি আবাসন। এখানে পাখিদের কেউ বিরক্ত করে না। পাখিরা সময় হলেই চলে আসে ক্যাম্পাসে। বিশেষ করে তারা পাখি কলোনিতে বসবাস করতে খুবই স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এছাড়াও এখানে তাদের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার ও প্রজনন ব্যবস্থা। কিছু পাখি গাছে প্রজনন করে, কিছু পানিতে। পরিয়ায়ী পাখিরা ক্যম্পাসে আসতে শুরু করে অক্টোবরের দিকে তারা মার্চ পর্যন্ত থাকে। কালো মানিক জোড়, ধলা মানিক জোড়, সরালি পাখি বেশির ভাগ আসে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাখিদের বসবাসের সুবিধার্থে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নানাভাবে সহায়তা করেছে। এ বছর প্রথমবারের মত জল ময়ুর এর প্রজনন ঘটতে দেখা গেছে। এটা আমাদের জন্য অনেক আনন্দের।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে পাখিদেরন আগমন ঘটে রাবি ক্যম্পাসে। পাখিদের জন্য । পর্যাপ্ত খাবার ও প্রজনন ব্যবস্থা থাকায় বছরের বিভিন্ন সময়ে পাখিরা ক্যম্পাসে আসে। পাখিদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সর্বদা সতর্ক আছে।
খবর কৃতজ্ঞতাঃ দৈনিক সানশাইন