রাজশাহী মহানগরীকে আরও আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন করে দেখতে চান রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষার্থীরা। এরই অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নকশা তৈরি করেছেন।
বিভাগের ১৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা চতুর্থ বর্ষের জোড় সেমিস্টারের একটি প্রকল্পের আওতায় এ কাজ করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু স্থাপনার বাহ্যিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিই নয়, আশেপাশের পরিবেশের সৌন্দর্য নিয়েও শৈল্পিক চিন্তাভাবনা থেকেই এ প্রকল্পের নকশা তৈরি করা হয়েছে।
সবুজ রাজশাহীর প্রাচীন স্থাপত্যকলার পাশাপাশি বেশকিছু বিনোদনকেন্দ্র প্রায় অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। নগরবাসীর বিনোদনের জায়গাও তেমন নেই। হাতেগোনা যে সব স্থাপনা রয়েছে সেগুলো শহরের সামাজিক উন্নয়নকেও ব্যহত করছে। এসব কথা মাথায় রেখেই পুরনো স্থানগুলোকে নতুনরূপ দিতে বিশেষ এই প্রকল্প।
নগরীর দৃশ্যপট পুনরুজ্জীবিতকরণ এ প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন হয়েছে বিভাগের ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন কোর্সের শিক্ষক শাম্মী আক্তার কেয়া এবং সামিউল সাব্বিরের নির্দেশনায়।
প্রকল্পটির মূল লক্ষ্যই ছিল পরিচিত স্থানগুলোকে এমনভাবে নকশা করা যেন সেগুলো নতুনমাত্রা ও মর্যাদা পায়। সুপরিকল্পিত নকশা পুরোনো স্থানকে নতুনরূপ দেয়ার পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধ বিকাশেও ভূমিকা রাখে।
জানা গেছে, এতে প্রথমে শিক্ষার্থীরা চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে রাজশাহী নিউ মার্কেট, তালামারি শহীদ মিনার, ভুবন মোহন পার্ক এবং কুমাড়পাড়া রবীন্দ্র-নজরুল মঞ্চ নিয়ে কাজ করেন। বর্তমানে অনেকটা অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে রয়েছে এসব স্থাপনা। সময়োপোযোগী নকশার অভাবে স্থানগুলোর পরিচিতি দিন দিন কমে যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিতে উঠে এসেছে এই চার স্থানের নানান দুর্গতি। তারা বলছেন, স্থানের ভুল ব্যবহারসহ স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং নিরাপত্তার অভাবে দিন দিন জৌলুশ হারাচ্ছে নগরীর ঐতিহাসিক ভুবন মোহন পার্ক।
শিক্ষার্থীরা জানান, শহরের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হলেও সাধারণ মানুষের জন্য বিনোদনকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি নগরীর নিউ মার্কেট। বরং পদ্মপুকুরেরমত পুরোনো আকর্ষণগুলোও অযত্নে হারিয়ে গেছে। আবার শতবর্ষী বটগাছ থাকার পরও তার সঠিক কোনো ব্যবহার নেই।
নিজস্ব পরিচিতি হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়েছে নগরীর তালাইমারী শহীদ মিনার এবং কুমাড়পাড়া রবীন্দ্র মঞ্চেরও।
এসব স্থানের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছেন শিক্ষার্থীরা। সেগুলোর সমাধান এবং আরও কিছু নতুন উপযোগ সৃষ্টিও করেছেন। স্থানগুলোকে এমনভাবে ডিজাইন করেছেন যেন তা পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রেখে সমসাময়িক যুগের চাহিদাও পূরণ করা যায়।
রাজশাহী নিউ মার্কেট : নগরীর নিউ মার্কেট নিয়ে কাজ করেছেন শিক্ষার্থী হুমায়রা ফাতেমা। তার ভাষ্য, রাজশাহী নিউ মার্কেটের দোকানগুলো তিন লেনে ভাগ করা থাকলেও সব লেনে মানুষ সমানভাবে যাতায়াত করে না। দেখা যায় বাইরে পার্কিংয়ের সুব্যবস্থা নেই। ফলে বাধ্য হয়েই মালবাহী ভ্যান বা বাইক নিউমার্কেটের ভেতরে যত্রতত্রভাবে পার্ক করা থাকে। যা ক্রেতাদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে।
আবার নিউমার্কেট বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে যুবকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু সেখানে বিনোদনের কোনো সুবিধাই নেই। এসব বিষয় বিবেচনা করে নতুন নিউ মার্কেটকে এমনভাবে চিন্তা করা হয়েছে যেনো সবগুলো লেনেই ক্রেতাদের সমান যাতায়াত হয়।
এর জন্য আমরা নিউ মার্কেটের পুরোনো ঐতিহ্য পদ্মপুকুরকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছি যা সাধারণ মানুষের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। এছাড়াও বাসরলতায় শোভিত করিডরের প্রস্তাব রাখা হয়েছে যা ক্রেতাদের একঘেয়েমি কাটাতে সাহায্য করবে।
কুমাড়পাড়া রবীন্দ্র-নজরুল মঞ্চ : নগরীর ফুদকিপাড়া মুন্নুজান প্রাথমিক বিদ্যালয়েরে ঠিক সামনে রবীন্দ্র-নজরুল মঞ্চ নিয়ে কাজ করেছেন শিক্ষার্থী ফারজানা জেসমিন। তিনি জানান, বহু বছর ধরেই স্থানীয়রা পার্কটিকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে আসছে।
পার্কটিতে একটি রবীন্দ্র-নজরুল মঞ্চ এবং একটি স্মৃতিসৌধ আছে যা স্থানীয় দুই শিশুর অকাল মৃত্যুতে
তাদের স্মৃতিচারণের জন্য বানানো হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল বর্তমান পার্ককে ব্যবহারকারীদের সুবিধা অনুযায়ী ল্যান্ডস্কেপিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন জোনে ভাগ করে দেয়া।
এছাড়াও মঞ্চ অভিমুখে দৃষ্টিনন্দনভাবে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য রাখা হয়েছে পরিকল্পিত আলোকসজ্জার ব্যবস্থা।
পার্কটিকে জনসাধারণের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য সামনের দেয়ালে টেরাকোটা ও দেয়ালচিত্রের মাধ্যমে রাজশাহীর ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।
তালাইমারী শহীদ মিনার : একই বিভাগের শিক্ষার্থী সুরঞ্জিত পাল কাজ করেছেন নগরীর তালাইমারী শহীদ মিনার নিয়ে। বলেন পদ্মা নদীর পাড়ে অবস্থিত হওয়ায় প্রচুর মানুষ এখানে ঘুরতে আসেন। কিন্তু এখানে বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে পর্যাপ্ত সুবিধা নেই।
তিনি আরও বলেন, রাতে আলোক স্বল্পতার কারণে নিরাপত্তার অভাবসহ বসার উপযুক্ত স্থান না থাকায় স্থানটি এখনও বিনোদনকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি। এ কারণে একে আরও আকর্ষণীয় করে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তোলাই ছিল আমদের মূল লক্ষ্য। এ জন্য শহীদ মিনারের সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার উদ্দেশ্যে দু’পাশে পলাশ ও কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগানোর কথা চিন্তা করেছি। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ঋতুকালীন গাছেরও প্রস্তাব করা হয়েছে, যা নদীর বাঁধ সংরক্ষণে সাহায্য করবে।
ভুবনমোহন পার্ক : এ নিয়ে কাজ করেছেন শিক্ষার্থী রাহাত শাহরিয়ার অতুল। তিনি বলেন, ভুবন মোহন পার্কের ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ হলেও তার বর্তমান অবস্থা খুবই শোচনীয়। আমাদের চিন্তা ছিল শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই পার্কটিকে একটি সামাজিক মিলনমেলার কেন্দ্রস্থল হিসেবে গড়ে তোলা। বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক ও জাতীয় দিনগুলোতে শহীদ মিনারের বেদিটিকে জনতার মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করার কথা চিন্তা করেছি।
ভাষা শহীদদের স্মরণে ও নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাস তুলে ধরতে পার্কের দু’পাশের দেয়ালের একটিকে ‘১৯৫২’ সালের ভাষা আন্দোলনের গ্রাফিতি ক্যানভাস হিসেবে ও অপরটিকে প্রদর্শনী দেয়াল হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তাব করেছি। শহীদ মিনারের চিড় বরাবর বিশেষ আলোকসজ্জার মাধ্যমে ‘নব আলোকরেখা’ স্থাপনের কথা চিন্তা করেছি। যা পার্কের প্রধান ফটক থেকেই জনসাধারণের নজর কাড়বে।
জানতে চাইলে প্রকল্পের সুপারভাইজার ও রুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের প্রভাষক সামিউল সাব্বির বলেন, এটি মূলত শিক্ষার্থীদের শ্রেণি প্রকল্প ছিল। যার পুরোটাই কল্পনাপ্রসূত। কিন্তু তারা বাস্তবিক সমস্যা ও সম্ভবনা নিয়ে কাজ করেছে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন যোগ্য।
খবর কৃতজ্ঞতাঃ জাগোনিউজ২৪