জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের র্যাংকিংয়ে বিভিন্ন সূচকে টানা ৪ বার দেশসেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে রাজশাহী কলেজ। বুধবার (১ লা এপ্রিল) কলেজটি গৌরবময় ১৪৮ বছর পূর্ণ করে ১৪৯ বছরে পদার্পণ করেছে।
প্রতিবছরই বর্ণাঢ্য আয়োজনে জন্মদিন পালন করে রাজশাহী কলেজ। কিন্তু প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস সংক্রমণরোধে এবছর কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন রাখা হয়নি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ফেসবুক ও অফিসিয়াল পেইজে বাণী দিয়েছেন কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান।
এতে তিনি বলেন, “আজ হাজারো ইতিহাসের জননী রত্নখনি রাজশাহী কলেজের ১৪৮তম প্রতিষ্ঠাদিবস। এই শুভক্ষণে সকল শুভানুধ্যায়ীকে প্রাণঢালা অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। শুভ জন্মদিন রাজশাহী কলেজ।
প্রতিষ্ঠাদিবসে কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এ কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্নে ও পরবর্তীতে কলেজটির শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে যাঁরা অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন তাঁদের প্রতি। ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন স্বাধীকার আন্দোলন এবং স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে এবং পরবর্তীতে নানান গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে মহান ত্যাগের দ্বারা দেশকে করেছে চিরঋণী এবং কলেজটিকে করেছে গৌরবান্বিত সে সকল অকুতোভয় শিক্ষার্থীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
তুলনাহীন প্রথিতযশা শ্রদ্ধাভাজন যে সকল অধ্যক্ষ ও অসাধারণ পান্ডিত্যসম্পন্ন যে সকল সম্মানিত শিক্ষাগুরুর নিপূণ হাতের কারুকার্যে ব্যতিক্রমী ও রত্নতূল্য হাজারো শিক্ষার্থীর জন্ম হয়েছে তাঁদের প্রতি অঢেল শ্রদ্ধা। কলেজটির নানান ঐতিহ্যের ধারা অক্ষুন্ন রাখতে এখনও যাঁরা যেমন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সুশীল সমাজ, স্থানীয় বিভিন্ন প্রশাসন, আপামর জনগণ, অভিভাবক, বর্তমান শিক্ষক- শিক্ষার্থী এবং বিশেষত যাঁরা যৌক্তিক লেখনি ও প্রচারের মাধ্যমের দ্বারা প্রতিষ্ঠানটিকে করেছে আজ দেশসেরা তাঁদের প্রতি অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা।
রাজশাহী কলেজ নিত্যনতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়ে বিশ্বময় তার দ্যুতি নিরবচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে আকাশসম মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাক- ১৪৮ তম প্রতিষ্ঠাদিবসে সে কামনা।”
১৮৭৩ সালের পহেলা এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী কলেজ। মাত্র ৬ জন ছাত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ব্রিটিশ আমল থেকেই শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের মর্যাদা পেয়ে এসেছে কলেজটি। অক্ষুন্ন রয়েছে সেই মর্যাদা। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজগুলোর মধ্যে ও শিক্ষামন্ত্রনালয়ের র্যাংকিংয়ে টানা ৪ বার সেরা কলেজের স্বীকৃতি রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
রাজশাহীর পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত কলেজটি ঢাকা ও চট্টগ্রাম কলেজের পরে বাংলাদেশের তৃতীয় প্রাচীনতম কলেজ। ছোট্ট পরিসরে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে প্রায় ত্রিশ হাজার শিক্ষার্থীকে পাঠদানের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গ ও দেশের শিক্ষাঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি।
১৮৭৩ সালে দুবলহাটীর রাজা হরলাল রায় বাহাদুরের আর্থিক সহায়তায় স্থাপিত হয় রাজশাহী কলেজ। ১৮৭৩ সালে এপ্রিলের ১ তারিখে রাজশাহী জেলা স্কুলে (বর্তমান কলেজিয়েট স্কুল) এফএ (ফার্স্ট আর্টস) শ্রেণী চালুর মাধ্যমে এর কার্যক্রম শুরু হয়।
কলেজটির প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন হরগোবিন্দ সেন। ১৮৭৭ সালের অক্টোবর মাসে স্নাতক কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কলেজের প্রথম ভবন (বর্তমান প্রশাসনিক ভবন) নির্মাণ করা হয় ১৮৮৪ সালে। ১৯০২ সালে পুঠিয়ার রাণী হেমন্তকুমারী তার নামে একটি হোস্টেল এবং কলেজের অধীনে মহারাণী হেমন্তকুমারী সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতকোত্তর কলেজ হিসেবে ১৮৮১ সালে এমএ কোর্স এবং ১৮৮৩ সালে আইন কোর্স পরিচালনার অনুমতি লাভ করে রাজশাহী কলেজ। কলেজে আইকম, বিকম (পাস) এবং বিকম (সম্মান) কোর্স চালু হয় যথাক্রমে ১৯৫২, ১৯৫৪ এবং ১৯৬১ সালে।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় একমাত্র রাজশাহী কলেজেই স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে পাঠদান করা হতো। দীর্ঘ পথযাত্রায় অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তি এ কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁদের মধ্যে এফ টি ডাউডিং, বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-এ-খুদা, ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন, ভাষাবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক ড. এনামুল হক, অধ্যাপক সুনীতি কুমার ভট্টাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ড. ইতরাত হোসেন জুবেরী প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৯৯৬ সালে এ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক কোর্সে পাঠদান বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০১০ সালে তা পুনরায় চালু করা হয়। বর্তমানে কলেজে ২৪টি বিভাগে স্নাতক সম্মান, স্নাতকোত্তর, ডিগ্রি ও এইচএসসি শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা হয়। কলেজের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে আলোকিত করে চলেছেন আড়াই শতাধিক সৃজনশীল, পরিশ্রমী ও মেধাবী শিক্ষক।
অবিভক্ত বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ছাড়াও আসাম, বিহার ও ওড়িশার শিক্ষার্থীরা রাজশাহী কলেজে পড়তে আসতেন। এই কলেজে শিক্ষা লাভ করেছেন বাংলাদেশের জাতীয় চার নেতার একজন শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান। এছাড়াও এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান, চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক, শিক্ষানুরাগী মাদার বখশ, সাহিত্যিক অক্ষয় কুমার মৈত্র, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য স্যার যদুনাথ সরকারসহ আরও অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ।
চীনা কারিগর মিস্ত্রিদের হস্তশিল্পের সমন্বয়ে ব্রিটিশশৈলীতে কাঠের সানশেড দিয়ে নির্মিত এই কলেজের প্রশাসন ভবনটি এখনো সগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কলেজের এই সুরম্য স্থাপত্যশৈলী এখনো সগৌরবে কলেজটির ঐতিহাসিক পরিচয় ঘোষণা করে, যা যেকোনো পথচারীকে আকৃষ্ট করে।
হাজি মুহাম্মদ মহসীন ভবন, ফুলার ভবন, প্রশাসন ভবনের মত লালরঙ্গা ভবনগুলো এখনও প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন। যে ভবনগুলো আজও সেই আমলের রাজকীয় স্থাপত্যশৈলীর কথা মনে করিয়ে দেয় আজকের তরুণ শিক্ষার্থীদের। এছাড়া বেশ কয়েকটি নতুন ভবনও রয়েছে। সেগুলোতেও করা হয়েছে প্রাচীন ভবনগুলোর মত লাল রং। ফলে লালরঙা ভবন রাজশাহী কলেজের অন্যতম বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে, এই কলেজেই রয়েছে ভাষা আন্দোলনে জীবন উৎসর্গকারী সব শহীদের স্মরণে নির্মিত দেশের প্রথম শহীদ মিনার।
সময়ের গড়ানোর সাথে নিজেকে আধুনিকতায় সাজিয়েছে রাজশাহী কলেজ। কলেজের প্রতিটি বিভাগে চালু করা হয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। শিক্ষকদের জন্য সরবরাহ করা হয়েছে প্রয়োজনীয় ল্যাপটপ। গবেষণা আর তথ্য বিনিময়ে বহির্বিশ্বের সাথে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগে দেয়া হয়েছে ওয়াই-ফাই সেবা। কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে শ্রেণিকক্ষ, প্রবেশমুখসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে লাগানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা।
প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে প্রায় ৩ লাখ বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে এক বিশাল গ্রন্থাগার। যেখানে রয়েছে পুরোনো দিনের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ছাড়াও নিত্যনতুন প্রয়োজনীয় বইসমূহ। মুক্ত জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রতিদিনই এখানে ভীড় জমান শিক্ষার্থীরা।
ক্লাসের বাইরে সহ-শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রয়েছে চল্লিশোর্ধ সংগঠন। এসকল সহ-সংগঠন শিক্ষার্থীদের মেধা মনন বিকাশে কাজ করে যাচ্ছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, মিডিয়ায় কাজ করতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের সাংবাদিকতা ও জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি (আরসিআরইউ), রোভার স্কাউট, মিরর বিতর্ক ক্লাব, ক্যারিয়ার ক্লাব, সংগীত একাডেমী, নৃত্য চর্চা কেন্দ্র, রক্তদানের প্রতিষ্ঠান বাঁধন, বরেন্দ্র থিয়েটার, অন্বেষণ, বিএনসিসি, ক্যারিয়ার ক্লাব, বিজনেস ক্লাব, এথিক্স ক্লাব, প্রেজেন্টেশান ক্লাবসহ বিভিন্ন বিভাগের স্বতন্ত্র একটি করে ক্লাব।
‘সুস্থ দেহ সুস্থ মন’– এই সত্য সামনে রেখে রাজশাহী কলেজে রয়েছে একটি ব্যায়ামাগার। এখানে শিক্ষার্থীরা তাঁদের শারীরিক ও মানসিক গঠনে ব্যায়ামসহ নানা অনুশীলন করে থাকেন। নামাজের জন্য রয়েছে দ্বিতল মসজিদ। শহরের বাইরের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস। ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা।
কলেজের রয়েছে পাঁচশ’র বেশি কম্পিউটার সংবলিত ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল কম্পিউটার ল্যাব’। কম্পিউটার ল্যাবে কলেজের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যতালিকার বাইরেও আউটসোর্সিং ও বিভিন্ন প্রোগ্রামিংয়ের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়াও বিভিন্ন বিভাগের আলাদা ল্যাবও রয়েছে।
ছাত্রছাত্রীরা যাতে ঘরে বসেও কলেজের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারে এজন্য কলেজের একটি নিজস্ব ডাইনামিক ওয়েবসাইট রয়েছে। আর রাজশাহী কলেজের বিভিন্ন সংবাদ ও সংবাদযোগ্য তথ্য প্রচারের জন্য চালু হয়েছে ‘রাজশাহী কলেজ বার্তা’ (িি.িৎপনধৎঃধ.পড়স) নামে নিজস্ব অনলাইন নিউজ পোর্টাল। এছাড়াও কলেজ পরিচালিত অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজ ও ফেসবুক গ্রুপ (বিন.ভধপবনড়ড়শ.পড়স/জধলংযধযরঈড়ষষবমবঙভভরপরধষ)।
কলেজের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি সৌন্দর্য বর্ধনেও পিছিয়ে নেই কলেজ প্রশাসন। কলেজের গুরুত্বপূর্ন পয়েন্টে নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন চত্ত্বর। লাগানো হয়েছে মৌসুমী ও বাহারি ফুলগাছ। মৌসুমে এসব ফুলের সৌরভ শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়ায় সজীবতা। এছাড়াও কলেজের রয়েছে একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীন রাস্তাগুলো নতুনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। কার্পেটিং করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ন চত্বর।
রাজশাহী কলেজের অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান প্রশাসন। কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমানের নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে কলেজের উন্নয়নের মহাযাত্রা।
খবর কৃতজ্ঞতাঃ দৈনিক সানশাইন