স্বাস্থ্যকর ও পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে দেশের সব শহরের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে রাজশাহী। রাজশাহীকে নানা নামে ডাকা হয়- সবুজ নগরী, শিক্ষা নগরী, শান্তির নগরী, রেশম নগরী বা সিল্ক সিটি। বাতাসে ভাসমান মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কণা দ্রুত কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিশ্বে পরিচিতি অর্জন করেছে রাজশাহী।
‘ও আমার বাংলা মা তোর/আকুল করা রূপের সুধায় হৃদয় আমার যায় জুড়িয়ে, যায় জুড়িয়ে’। গ্রাম-বাংলার এমন প্রতিচ্ছবি কোনো অমূলক চাওয়া নয়, কেননা এটাই বাংলার আসল প্রতিচ্ছবি। তবে তা যদি হয় নগরায়ণে? হ্যাঁ, পাঠক গ্রাম-বাংলার এমন প্রতিচ্ছবি যেন রাজশাহী শহরেও! পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সবুজে মোড়ানো এই শহরের সাফল্যের অন্যতম কারণ হচ্ছে পরিকল্পিত নগরায়ন ও বৃক্ষরোপণ। এছাড়া নগর উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও ‘জিরো সয়েল’ প্রকল্প গ্রহণ অন্যতম।
এই শহরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ ‘ঢোপকল’। অতীতে প্রমত্ত পদ্মা পাড়ের প্রাচীন নগরী রাজশাহীতে সুপেয় পানির অভাব ছিল প্রকট। পানিবাহিত রোগ কলেরায়, আমাশয়ে মৃত্যুবরণ করত অসংখ্য মানুষ।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৩৪-৩৯ মেয়াদে রাজশাহী পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকাকালে রায় ডি এন দাশগুপ্তের উদ্যোগে ও রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায় নগরবাসীকে সুপেয় পানি সরবরাহের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হয়। তৎকালীন পুঠিয়ার মহারানি হেমন্ত কুমারী একাই ৬৫ হাজার টাকার অনুদান দেন।
বড় অঙ্কের একক অনুদানের কারণে রাজশাহী জেলা বোর্ডের দান করা জমিতে মহারানি হেমন্তকুমারীর নামেই ‘ওয়াটার ওয়ার্কস’ স্থাপিত হয়। সেই সময় ঢোপকলে পানি সরবরাহব্যবস্থার পাইপগুলো ছিল ‘কাস্ট আয়রন’-এর এবং প্রয়োজনীয় অন্য দ্রব্যগুলো পিতলের তৈরি ছিল। সিমেন্টের তৈরি ঢোপকলগুলো ব্যতীত অন্য সবকিছুই ইংল্যান্ড থেকে প্রস্তুত করে নিয়ে আসা হয়েছিল।
ইতিহাসের বই থেকে জানা যায়, উড়িষ্যা থেকে রাজমিস্ত্রি এনে নগরীর পাঁচআনী মাঠে তৈরি করা হয় সিমেন্টের ঢোপকলগুলো। চার ফুট ব্যাসের এসব কল ভূমি থেকে প্রায় বারো ফুট উঁচু। তৈরি করা হয় ইটের খোয়া ও সিমেন্টের ঢালাইয়ে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত টিনের মতো ঢেউ খেলানো প্লাস্টার দিয়ে। উল্লেখ্য, হেমন্ত কুমারী ওয়াটার ওয়ার্কসই তখন হয়ে ওঠে পৌরসভা ও আশপাশের এলাকায় বিশুদ্ধ পানির আধার। লোকমুখে হেমন্ত কুমারীর ঢোপকল নামেই এই ওয়াটার ওয়ার্কস পরিচিতি লাভ করে। এমন ঢোপকল দিনাজপুর ও ভারতের মালদহ জেলায়ও ছিলো।
তখন হেমন্তকুমারী ওয়াটার ওয়ার্কসে প্রতিদিন ৭০০ ঘনমিটার ভূগর্ভস্থ পানি শোধন করা হতো। এই পানি শোধন কেন্দ্রে আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ ও পানির ক্ষারতা দূর করার ব্যবস্থা ছিল। এই শোধিত পানি পাইপলাইনের মাধ্যমে নগরের মোড়ে মোড়ে স্থাপিত ১০০টির বেশি ঢোপকলে গিয়ে পৌঁছাত। ঢোপকলে জমা পানি সাধারণ মানুষ নিজেদের প্রয়োজনমতো নিয়ে যেতেন।
সেসময় সারা দিনে মাত্র দুই ঘণ্টা পানি সরবরাহ করা হতো। এ জন্য প্রতিটি ঢোপকলকে পানি রিজার্ভ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ফলে সারা দিনই পানি পাওয়া যেত। ১৯৬৫ সালে হেমন্তকুমারী ওয়াটার ওয়ার্কসকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। পরে বাংলাদেশ সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর নগরের পানি সরবরাহব্যবস্থার কিছুটা উন্নয়ন ঘটায়। ১৯৮০ সালের পর ডাচ সাহায্যপুষ্ট একটি প্রকল্প এবং ১৯৯৬ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর মহানগরে পানি সরবরাহব্যবস্থা উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়।
সড়ক প্রশস্তকরণ ও বর্তমান পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ না খাওয়ায় সিটি করপোরেশন ঢোপকলগুলোর বেশির ভাগই ভেঙে ফেলেছে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কয়েকটি রাস্তার মোড়ে অপসারিত ঢোপকলের কাঠামো সাজিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ২০১০ সালের দিকে রাজশাহী নগরে প্রায় ২০টি ঢোপকল ছিল। সময়ের বিবর্তনে উপযোগিতা হারানোয় এবং উন্নয়নের অংশ হিসেবে রাস্তা সম্প্রসারণের প্রয়োজনেও অনেক ঢোপকলকে উচ্ছেদ হতে হয়েছে।
প্রতিটি শহরেরই একটা অতীত ইতিহাস থাকে, থাকে কিছু ঐতিহ্য। এগুলো নিয়ে শহরের নাগরিকদের থাকে গর্ব। রাজশাহীও এর ব্যতিক্রম নয়। রাজশাহীর আছে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। আধুনিক মহানগরীর ভাঁজে ভাঁজে এখনও দেখা যায় সেসব ঐতিহ্যের কিছু কিছু নিদর্শন। এমনই এক ঐতিহাসিক নিদর্শন হলো রাজশাহীর ঢোপকল। রাজশাহীর ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য কিছু ঢোপকল চালু রাখা উচিত বলে মনে করেন সচেতন নগরবাসী, যা কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে রাজশাহী মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ কিছু মোড়ে।