এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এসেছিল বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল বিজয়, উদিত হয়েছিল নতুন সূর্য। কিন্তু রাজশাহীতে স্বাধীনতার সেই সূর্য কিরণের ছোঁয়া লেগেছিল ১৮ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার দুই দিন পর! মুক্তিবাহিনী, মিত্রবাহিনী ও গেরিলা যোদ্ধাদের ক্রমাগত আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদররা কোণঠাসা হয়ে পড়লেও রাজশাহীতে স্বাধীন দেশের প্রথম পতাকা ওড়ে ডিসেম্বরের ১৮ তারিখে। রাজশাহীর বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে লড়াই করেছেন একাধিক রণক্ষেত্রে, চালিয়েছেন নানা খণ্ডযুদ্ধ ও গেরিলা হামলা।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশ যখন বিজয়ের উল্লাসে মাতোয়ারা, তখনও রাজশাহী শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়িয়েছে শত্রু বাহিনীর বহর! সঙ্গত কারণে রাজশাহীবাসীর স্মৃতিপটে দাগ কেটে যাওয়া অবিস্মরণীয় দিন হলো ১৮ ডিসেম্বর।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজশাহী ছিলো ৭নম্বর সেক্টরে। বিদেশি প্রতিনিধিদের পরিস্থিতি জানাতে বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ সীমান্ত পার হয়ে আসেন। একাত্তরের ১৭ জুন ২৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজশাহী শহরে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শুরু করে তাদের অ্যাকশন অপারেশন। পাকিস্তানি সৈন্য ও দোসরদের নির্যাতন হত্যাযজ্ঞ বাড়তে থাকে। রাজশাহীর নারীরাও অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে-কেউ সীমান্ত পার হয়ে ভূমিকা রাখেন, কেউ এ পারেই হয়ে ওঠেন দুঃসাহসিক গেরিলা।
সে সময় আলবদর বাহিনী গঠনের পর শুরু হয় ত্রাস, হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ নানা নিপীড়ন। পাকিস্তানী সৈন্যরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমিতে নির্মমভাবে হত্যা করে প্রায় চার হাজার নিরীহ মানুষকে। নারীরাও তাদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাননি।
রাজশাহী অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহকারী ও গবেষক ওয়ালিউর রহমান বাবু গণমাধ্যমকে জানান, পাকিস্তানি সৈন্যরা দোসরদের মদদে বিভিন্ন কায়দায় লোকজনকে হত্যা করে রাজশাহীর পদ্মা নদীতে ফেলে দেয়। এ সময় বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ ঢুকে পড়তে থাকে রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে। ২৫ নভেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজশাহী মহানগরীর শ্রীরামপুর বাবলাবন চরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জীবন্ত অবস্থায় বালির মধ্যে পুঁতে হত্যা করে। সবকিছু সহ্য করে স্বাধীনতার দিন গুণতে থাকে রাজশাহীর মানুষ। মিত্র বাহিনীর বিমানকে স্বাগত জানাতে সবাই তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। সে সময় পাক সেনাদের বিমান বোমা ফেলতে থাকলো রাজশাহীতে। লালগোলা সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ও সেখপাড়া সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর রশিদের নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাক সেনাদের সাথে লড়াই করে মুক্ত করে ফেলে রাজশাহীর গ্রামাঞ্চল।
মহদিপুর সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর রাজশাহী অ্যাডভান্সের পরিকল্পনা নেন। তিনি ১৪ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জে শহীদ হন। এরপর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী রাজশাহীর দিকে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়। ১৬ ডিসেম্বর পরাজয় বরণের পর যৌথ বাহিনীর এই অগ্রগামী দল পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছ থেকে সাদা পাগড়ী ও আত্মসমর্পণের চিঠি নিয়ে রাজশাহী শহরে বীর দর্পে প্রবেশ করে। তাদের চা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়, মহানগরীর সোনাদিঘীর মোড়ে সাংবাদিক মঞ্জুরুল হকের বাড়িতে।
১৭ ডিসেম্বর সকালে শহরের বিভিন্ন এলাকা ও আশেপাশে মোতায়েনকৃত পাক সেনারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসে। এদিন কাজী আমিরুল করিমের নেতৃত্বে মোঃ শরিফুল ইসলাম, আবু আলম, নূর এলাহী খোকনসহ রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ১০ম শ্রেণীর মোট ৫ জন ছাত্র তাদের স্কুলের ছাদে বাংলাদেশের মানচিত্র সম্বলিত জাতীয় পতাকা উড়ান। পতাকাটি মাছ ধরা ছিপের লাঠিতে উড়ানো হয়েছিল। মাস্টারপাড়ার বাড়িতে অবস্থানরত প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমানকে ছাত্ররা এ সময় বাড়ি থেকে ডেকে এনে উপস্থিত করেছিলেন। পতাকাটি বানিয়েছিলেন আমিরুলের বড় বোন ফাতেমা আখতারী যার দৈর্ঘ্য ছিল দেড় ফিট।

অবশেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হল, জেলখানা ও বিভিন্ন বন্দিশালা থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে নির্যাতিত মানুষেরা। স্বজন হারানোর কষ্ট আর স্বাধীনতার উল্লাসে গোলাপ পানি ফুলের পাপড়ী দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা-মিত্র বাহিনীকে বরণ করে নেয় রাজশাহীর মানুষ। ১৮ ডিসেম্বর মুক্ত হয়ে যায় রাজশাহী! রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা মাঠে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলেন লাল গোলা সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। পরে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজশাহী ছেড়ে চলে যায় নাটোরে। তাদের দোসররা এখানে সেখানে লুকিয়ে যায়। খাদ্য সংকট এড়াতে বিভিন্ন পাড়া মহল্লা থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর জন্য খাবার সরবরাহ করা হয়। রাজশাহীর মানুষ সেদিন থেকে নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
রাজশাহীর মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বদিউজ্জামান টুনু ও নূর হামীম রিজভীকে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ২০০৬ সাল থেকে ১৮ ডিসেম্বরকে রাজশাহী মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।