সিল্কের প্রসঙ্গ আসলেই অকপটে চলে আসে রাজশাহীর নাম। চোখে ভেসে ওঠে অনিন্দ্য সুন্দর এক মোলায়েম শাড়ীর কথা। রাজশাহী জেলা প্রাচীনকাল থেকেই রেশম ও রেশমজাত পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানিতে ভারতবর্ষের যেকোনো অঞ্চলের তুলনায় শীর্ষ স্থানে অবস্থান করে এসেছে।
দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে রাজশাহীর রেশম শিল্প।
রাজশাহী সিল্ক প্রসঙ্গে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক হান্টারের উক্তি, ‘রাজশাহী জেলায় রেশম সুতা প্রস্তুত এবং রেশম বস্ত্র বয়ন বহু শতাব্দী পূর্ব থেকেই হয়ে আসছে।’ মোগল আমলে শিল্পটি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এগিয়ে যায়। ওলন্দাজ বণিকেরা রাজশাহী শহরে গঙ্গার (পদ্মা) তীরে একটি বাণিজ্যিক কুঠি স্থাপন করে। যেটি পরবর্তী সময়ে বড় কুঠি নামে অভিহিত হয়।
ইউরোপীয় বণিকেরা এ দেশে ব্যাপকভাবে আসা শুরু করে সপ্তদশ শতাব্দী থেকে। তারা আসার আগে বাংলাদেশে গ্রামকেন্দ্রিক অসংখ্য বাজার-বন্দরে দেশীয় কৃষিজাত ও কুটিরশিল্পজাত দ্রব্যাদির বেচাকেনা চলত। বৃহত্তর রাজশাহীতে বোয়ালিয়া, নাটোর, তাহেরপুর, মীরগঞ্জ, চারঘাট, কাপাশিয়া এসব নদীবন্দর রেশম ও কার্পাস সুতা এবং বস্ত্র কেনাবেচার জন্য বিখ্যাত ছিল।
রাজশাহী সিল্কের প্রধান উপাদান হলো রেশম। সুক্ষ্ম তুঁত রেশম দিয়ে তৈরি রাজশাহীর সিল্ক শাড়ির জনপ্রিয়তা সিল্কের শাড়িগুলোর মধ্যে শীর্ষে। রেশমের মধ্যে সর্বাধিক সুক্ষ্ম তুঁত রেশম দিয়ে তৈরি হওয়ায় এটি তেমন নোংরা হয় না, পরিষ্কার করা সহজ। আবার, রাজশাহী সিল্ক পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবান্ধব।

সিল্ক শাড়ির সৌন্দর্য, ঐতিহ্য, নমনীয়তা, ব্যবহারের আরামদায়কতা-এসব দিক বিচারে এগিয়ে থাকায় রাজশাহীর সিল্ক শাড়ি ভোক্তাদের কাছে পেয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। এই শাড়ির চাহিদা থাকে বছড়জুড়েই। শুধু শাড়ি নয় রাজশাহীর সিল্কের থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি ও শার্টের চাহিদা বাড়ছে ক্রমেই। বিভিন্ন উৎসব, অনুষ্ঠান, ঈদ, পূজা-অর্চনায় বাঙালি মেয়েদের পছন্দের তালিকায় প্রথমেই থাকে রাজশাহীর সিল্ক শাড়ি। আর ছেলেদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে সিল্কের পাঞ্জাবি।
বিশেষ করে বড় উৎসবগুলোতে কাপড় কেনার প্রথম তালিকায় রাজশাহী সিল্ক থাকে। কোয়ালাটি ভালো ও খাঁটি সিল্ক হওয়ায় ক্রেতাগণ রাজশাহী সিল্ক কিনে থাকেন। রাজশাহীতে সব রকমের দামের মধ্যেই সিল্ক পাওয়া যায়। সাধ্যের মধ্যে দাম ও মানে ভালো হওয়ার কারণে নিজেদের জন্য, আত্মীয় স্বজনদের উপহার দেবার জন্য রাজশাহী সিল্ক অনেকেরই প্রথম পছন্দ।
সুঁই-সুতাকাতান, মসলিন, স্টিজ, কটিসিল্ক, জয়শ্রি, সিল্ক কাতান, ওয়াটার কাতান, জামদানি কাতান, বরকাতান, ধুপিয়ানা, ঝর্নাকাতান শাড়ি, থ্রি-পিস, ওরনা, পাঞ্জাবি, শার্ট, ফতুয়া ও স্কার্ফ, বলাকা সিল্কের শাড়ি, পাঞ্জাবি, শার্ট, স্কার্ফ ও ওড়নার বিভিন্ন ডিজাইনের চাহিদা অনেক।
জাতভেদে শাড়ি বিক্রি হয় ২ হাজার ১০০ থেকে ২০ হাজার টাকায়। থ্রী-পিসের ক্ষেত্রে সাড়ে ৪ হাজার থেকে ১৮ কিংবা ২০ হাজার টাকার মধ্যে সব রকমের কালেকশন রয়েছে। এছাড়াও সাড়ে ৩ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যেই পাওয়া যায় বাহারি ডিজাইনের পাঞ্জাবি।

রাজশাহীর বিসিক শিল্প নগরীর প্রধান পাঁচটি রেশম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সপুরা সিল্ক, ঊষা সিল্ক, রাজশাহী সিল্ক ফ্যাশন, আমেনা সিল্ক ও মহানন্দা সিল্ক সারা বছর ধরে আধুনিকমানের নতুন নতুন নকশার পোশাক তৈরি করে থাকে।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজেদের ব্র্যান্ডেই পোশাক তৈরি করে নিজেদের শোরুমের মাধ্যমে বিক্রি করে। রাজশাহী ছাড়াও ঢাকা এবং চট্টগ্রামসহ দেশের বাইরেও এ প্রতিষ্ঠানগুলোর একাধিক শোরুম রয়েছে। তবে প্রতিটি শোরুমই পরিচালিত হয় রাজশাহী থেকে।

রাজশাহীতে রেশম শিল্পের জন্য একটি সিল্ক কারখানা এবং একটি সিল্ক গবেষণা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা হয়েছে। আনন্দের খবর হলো, দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী সিল্ক এখন ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য। দেশের ঐতিহ্যবাহী এ পণ্যের জিআই স্বীকৃতির ফলে নতুন করে বিশ্ববাজারে এর ব্র্যান্ডিংয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে। জিআই হিসেবে ব্র্যান্ডিং হলে একদিকে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে, অন্যদিকে পণ্যের দাম বেশি পাওয়া যাবে। বর্তমানে দেশে মালবেরি রেশম তৈরি হয়। রেশম পোকা তুঁত পাতা খাওয়ার পর মুখ থেকে নিঃসৃত লালা থেকে ২০ থেকে ২২ দিনে রেশম গুটি তৈরি হয়। গুটি থেকে সুতা এবং সুতা থেকে রেশম কাপড় তৈরি হয়। রেশম কাপড়ের একটি ব্র্যান্ডের নাম রাজশাহী সিল্ক। অষ্টাদশ শতকে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে রাজশাহী সিল্ক রপ্তানি হতো। এখন নতুন করে রপ্তানি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। জিআই স্বীকৃত পণ্য বিশ্বের যে কোনো দেশে কদর রয়েছে।
স্বাভাবিক অবস্থায় রাজশাহী সিল্কে ১১% জলীয় অংশ থাকে। এ কারণে শীত, গ্রীষ্ম সব ঋতুতে রাজশাহী সিল্ক পরিধান করা আরামদায়ক। পেটেন্টস, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগের ভৌগলিক নির্দেশক পণ্যের জার্নাল-৮ এ এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
মো. আব্দুর রশীদ খানের লেখা, ‘বাংলাদেশের ঐতিহ্য রাজশাহী সিল্ক’- বই অনুযায়ী ১৭৫৯ সাল বা তার আগে থেকেই রাজশাহীতে রেশম পোকার উৎপাদন ও এর কাপড় ব্যবহার হয়ে আসছে! প্রিয় পাঠক, আরামদায়ক পোশাক হিসেবে নির্দ্বিধায় কিনতে পারেন রাজশাহী সিল্ক।