রাজশাহী বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী জেলা। আম ছাড়াও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জেলা হিসেবে দেশব্যাপী বিখ্যাত রাজশাহী। রাজশাহীকে শিক্ষানগরী এবং রেশমের নগরীও বলা হয়। এই জেলার উত্তরে দিনাজপুর ও পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম দিনাজপুর, পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা, পূর্বে পাবনা ও বগুড়া জেলা এবং দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত ঘেঁষে পদ্মা নদী প্রবাহিত।
প্রিয় রাজশাহী এক্সপ্রেস পাঠক, ‘রাজশাহী’ নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলেই কয়েক শতাব্দী পূর্বে ফিরে যেতে হয়। এ শহরের প্রাচীন নামটি ছিল ‘মহাকাল গড়’। পরে রূপান্তরিত হয়ে দাঁড়ানো রামপুর- বোয়ালিয়া থেকে ‘রাজশাহী’ নামটির উদ্ভব কিভাবে হলো এর সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা নেই। ব্রিটিশ আমলের প্রাথমিক যুগের ইতিহাসেও রাজশাহী নামে কোন জনপদ বা স্থানের উল্লেখ নেই। অনেকে মনে করেন, এই জনপদ একদা বহু হিন্দু, মুসলিম, রাজা, সুলতান আর জমিদার শাসিত ছিল বলে নামকরণ হয়েছে রাজশাহী।
ঐতিহাসিক ব্লকম্যানের (Bolch Mann) মতে, খ্রিষ্টীয় ১৫শ শতকে গৌড়ের মুসলিম সালতানাত এই জেলার ভাতুড়িয়ার জমিদার রাজা গণেশ কতৃর্ক আত্মসাতের সময় থেকে রাজশাহী নামের উদ্ভব হয়েছে। তবে বাংলা ভাষায় আমরা একই অর্থের অনেক শব্দ দুই বার উচ্চারণ করে থাকি। যেমন শাক-সবজি, চালাক-চতুর, ভুল-ভ্রান্তি, ভুল-ত্রুটি, চাষ-আবাদ, ধার-দেনা, শিক্ষা-দীক্ষা, দীন-দুঃখী, ঘষা-মাজা, মান-সম্মান, দান-খয়রাত, পাহাড়-পর্বত, পাকা-পোক্ত, বিপদ-আপদ ইত্যাদি। অদ্ভুত ধরণের এই ‘রাজশাহী’ শব্দের উদ্ভবও যে এভাবে ঘটে থাকতে পারে তা মোটেই উড়িয়ে দেয়া যায় না! ফলে এই নামকরণ নিয়ে অনেক কল্পকাহিনীও রয়েছে।
অনেকের মতে, সংস্কৃত ‘রাজ’ আর ফারসি ‘শাহ’ এই শব্দ দুটির সমন্বয়ে উদ্ভব হয়েছে মিশ্রজাত শব্দটির। অন্যদিকে ব্লকম্যানের অভিমত গ্রহণে আপত্তি করে বেভারিজ (Beveridge) বলেন, নাম হিসেবে রাজশাহী অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন এবং এর অবস্থান ছিল রাজা গণেষের জমিদারী ভাতুড়িয়া পরগনা থেকে অনেক দূরে। রাজা গণেশের সময় এই নামটির উদ্ভব হলে টোডরমল প্রণীত খাজনা আদায়ের তালিকায় অথবা আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী নামক গ্রন্থে সেটার উল্লেখ অবশ্যই পাওয়া যেত। ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের মতে, নাটোরের রাজা রামজীবনের জমিদারী রাজশাহী নামে পরিচিত ছিল এবং সেই নামই ইংরেজরা গ্রহণ করেন এই জেলার জন্য।
অনেকে এসব ব্যাখ্যাকে যথার্থ ইতিহাস মনে করেন না। তবে ঐতিহাসিক সত্য যে, বাংলার নবাবী আমল ১৭০০ হতে ১৭২৫ সালে নবাব মুর্শিদকুলি খান সমগ্র বাংলাদেশকে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য ১৩টি চাকলায় বিভক্ত করেন। যার মধ্যে ‘চারুলা রাজশাহী’ নামে একটি বৃহৎ বিস্তৃতি এলাকা নির্ধারিত হয়। এর মধ্যে প্রবাহিত পদ্মা বিধৌত ‘রাজশাহী চাকলা’-কে তিনি উত্তরে বর্তমান রাজশাহী ও দক্ষিণে মুর্শিদাবাদের সঙ্গে অপর অংশ রাজশাহী চাকলা নামে অভিহিত করেন। প্রথমে সমগ্র চাকলার রাজস্ব আদায় করতেন হিন্দু রাজ-জমিদার উদয় নারায়ণ। তিনি ছিলেন মুর্শিদকুলির একান্ত প্রীতিভাজন ব্যক্তি, যে জন্য নবাব তাকে রাজা উপাধী প্রদান করেন। দক্ষিণ চাকলা রাজশাহী নামে বিস্তৃত এলাকা যা সমগ্র রাজশাহী ও পাবনার অংশ নিয়ে অবস্থিত ছিল, তা ১৭১৪ সালে নবাব মুর্শিদকুলি খান নাটোরের রামজীবনের নিকট বন্দোবস্ত প্রদান করেন। এই জমিদারী পরে নাটোরের রাণী ভবানীর শাসনে আসে ও বহু অঞ্চল নিয়ে বিস্তৃতি লাভ করে। অনেকের মতে, প্রথম রাজা উদয় নারায়ণের উপর প্রীতিবশত এই চাকলার নাম রাজশাহী করেন নবাব মুর্শিদকুলি খান।
কিন্তু ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র মতে, রাণী ভবানীর দেয়া নাম রাজশাহী। আবার, মি. গ্রান্ট লিখেছেন, রাণী ভবানীর জমিদারীকেই রাজশাহী বলা হতো এবং এই চাকলার বন্দোবস্তের কালে রাজশাহী নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
নবাবী আমল থেকেই বৃহত্তর রাজশাহীর প্রশাসনিক কাযর্ক্রম পরিচালনা হতো নাটোর থেকে। নাটোর রাজ বৃহত্তর রাজশাহীর প্রশাসনিক প্রধানের দায়িত্ব পালন করতেন। ব্রিটিশ শাসনের পত্তন হলেও সে সূত্র ধরে নাটোরই প্রশাসনিক সদর ছিল। তখন রাজশাহী মহানগর তৎকালীন বোয়ালিয়া ছিল বিখ্যাত বাণিজ্য বন্দর। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে নাটোর ক্রমশ অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে। নারদ নদের মুখ বালি দ্বারা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে বন্যার দূষিত পানি নাটোর শহরে আটকে পড়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শহরবাসী বিভিন্ন পীড়ায় আক্রান্ত হতে আরম্ভ করে।
এই দুরবস্থায় কতৃর্পক্ষ জেলা সদরদপ্তর রাজশাহীর শ্রীরামপুরে স্থানান্তরিত করে ১৮২৫ সালে। ফলে শ্রীরামপুর শহরে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু ১৮৫০ সালে প্রবল বন্যা হয় এবং শ্রীরামপুর নদী গর্ভে ভেঙ্গে পড়ে এবং পার্শ্ববর্তী বুলনপুরে সরকারি প্রশাসনিক দপ্তর স্থানান্তরিত করা হয়।
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন