শিরোপা জয়ের কত প্রস্তুতিই না সেরে রেখেছিল ইংল্যান্ড। ৫২ বছর পর আবারও সোনালি ট্রফিটা হ্যারি কেইনের হাতে শোভা পাবে- এই আশায় ইংলিশরা মস্কোয় এসে তাবু গেঁড়ে বসেছিল। কীভাবে বিশ্বকাপকে তারা বরণ করে নেবে- সেসব প্রস্তুতির অংশ বিশেষ তারা তুলে ধরছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের এক ফ্লাইটে করে কীভাবে সোনালি ট্রফিটা ফিরিয়ে নেয়া হবে, সেসবও প্রকাশ করা হচ্ছিল।
কিন্তু মানুষ যা চায়, তার কি সবকিছু হয়! না হয় মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে সাদার ওপর ক্রস জার্সি পরা অংশটায় এভাবে নীরবতা, নিস্তব্ধতা ভর করতো না। হ্যারি কেইনদের চোখের জ্বলে ভাসতে হতো না। প্রথমবার বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার জন্য আত্মপ্রত্যয়ী ক্রোয়াটদের সামনে শেষ পর্যন্ত উড়ে যেতে হলো ইংল্যান্ডকে।
নির্ধারিত সময় ৯০ মিনিটের খেলা ১-১ গোলে ড্র থাকার পর খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। এই অতিরিক্ত সময়েই মারিও মানজুকিচের অসাধারণ এক গোলে ইংল্যান্ডকে ২-১ ব্যবধানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছে গেল ক্রোয়েশিয়া।
১০৯ মিনিটে অসাধারণ গোলটি করলেন মারিও মানজুকিচ। ইংল্যান্ডের বক্সের মধ্য থেকেই বলটা প্রথমে ফিরে আসে। লাফ দিয়ে আলতো করে হেডে আবারও ইংল্যান্ডের জালের সামনে বলটা ঠেলে দেন ইভান পেরিসিচ। জন স্টোনকে পেছনে ফেলে বলটির নিয়ন্ত্রণ নিলেন মারিও মানজুকিচ। গোলরক্ষক পিকফোর্ডও বলের কাছে আর পৌঁছাতে পারলেন না। তার আগেই মানজুকিচ বাম পায়ের অসাধারণ এক শট নিলেন। পিকফোর্ডকে ফাঁকি দিয়ে বল জড়িয়ে গেলো ইংল্যান্ডের জালে। গোওওওল। ক্রোয়েশিয়া ২-১ ইংল্যান্ড।
অথচ আগে গোল খেয়ে পিছিয়ে না পড়লে খুব সম্ভবত নিজেদের হুঁশ হয় না ক্রোয়েশিয়ারদের। তাই তো দেখা গেল চলতি বিশ্বকাপে টানা চতুর্থ ম্যাচে প্রথমে এক গোল হজম করেও, পরে গোল দিয়ে ম্যাচে ফেরার নজির স্থাপন করল তারা। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় সেমিফাইনাল ম্যাচের শুরুতেই গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়া ক্রোয়েশিয়া দ্বিতীয়ার্ধে গোল শোধ করে ম্যাচ নিয়ে যায় অতিরিক্ত সময়ে। যার ফলে বেঁচে থাকে তাদের প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলার স্বপ্ন।
৫২ বছর আগে ১৯৬৬ সালে নিজেদের ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ছাড়া আর কখনো বিশ্বকাপের ফাইনালেই উঠতে পারেনি ইংল্যান্ড। ৫২ বছর পর ট্রফি জয়ের মিশনে এসে ম্যাচের প্রথমার্ধেই ফাইনালের পথে এক পা দিয়েই রেখেছিল ডেভিড ব্যাকহাম, স্টিভেন জেরার্ডদের উত্তরসূরিরা।
লুঝনিকি স্টেডিয়ামে কেইরান ট্রিপারের করা গোলে ম্যাচের পঞ্চম মিনিটেই এগিয়ে যায় ইংলিশরা। পুরো প্রথমার্ধ এই এক গোলের লিড নিয়েই পার করে দেয় তারা। তবে দ্বিতীয়ার্ধে ফিরে গোল শোধ করে দেন ক্রোয়েশিয়ার ইভান পেরিসিচ। ফলে অতিরিক্ত ৩০ মিনিট সময়েই নিয়ে যাওয়া হয় দুই দলের মধ্যকার সেমিফাইনাল ম্যাচটি।
ম্যাচের পঞ্চম মিনিটে ক্রোয়েশিয়ান অধিনায়ক লুকা মদ্রিচ ডি বক্সের বাইরে ডেলে আলিকে ফাউল করলে ফ্রি কিক পায় ইংল্যান্ড। সরাসরি শটে গোল করে ইংল্যান্ডকে এগিয়ে দেন ট্রিপার। ২০০৬ সালের পর প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে ফ্রি কিক থেকে গোল পায় ইংল্যান্ড। এছাড়া চলতি বিশ্বকাপে সেট পিসে করা তাদের নবম গোল ছিল এটি। ম্যাচের শুরুতেই গোল করে মানসিকভাবে এগিয়ে যায় থ্রি লায়নসরা।
অন্যদিকে ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলার সুখস্মৃতিকে আরো বাড়িয়ে নেয়ার লক্ষ্য নিয়ে খেলতে নামা ক্রোয়েশিয়া, এক গোল খেয়ে হয়ে পড়ে ছন্নছাড়া। প্রথম গোলের ধাক্কা গুছিয়ে উঠতে চলে যায় আরো কিছু সময়। এই সুযোগে বারবার ক্রোয়েটদের রক্ষণ কাঁপিয়ে তোলেন হ্যারি কেইন, ডেলে আলিরা।
ম্যাচের ২২তম মিনিটে বাজে এক ভুল করে বসেন ক্রোয়েশিয়ার গোলরক্ষক ড্যানিয়েল সুবাসিচ। বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে তিনি দিয়ে দেন রহিম স্টার্লিংয়ের পায়ে। স্টার্লিং দুর্দান্ত চতুরতায় তা কেইনকে দিলেও, অফসাইডের ফাঁদে ধরা পড়েন ইংলিশ অধিনায়ক। সেই যাত্রায় বেঁচে যান সুবাসিচ।
এর খানিক বাদে উইং দিয়ে ইংল্যান্ডের রক্ষণে আক্রমণ সাজায় ক্রোয়েশিয়া। ছোট ছোট পাসে সামনে এগিয়ে হুট করেই বুলেট গতির শট নেন আনতে রেবিক। তবে ইংলিশ গোলরক্ষক পিকফোর্ড সতর্ক থাকায় গোল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয় ক্রোয়েশিয়া।
পুরো প্রথর্মাধে পরিচ্ছন্ন ফুটবলের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দুই দল। যার ফলে ৪৫ মিনিটে একবারের জন্যও কোনো কার্ড বের করতে হয়নি রেফারিকে। তবে প্রথমার্ধের ৫৩ শতাংশ বল নিজেদের দখলে রেখেও আসল কাজ গোল করতে পারেনি ক্রোয়েশিয়া। এ সময় ইংল্যান্ডের ২টি শটের বিপরীতে ক্রোয়েশিয়া গোলমুখে করে ৩টি শট।
দ্বিতীয়ার্ধে আর নিজের পকেট থেকে কার্ড বের করা থেকে বিরত থাকতে পারেননি রেফারি। ম্যাচের দ্বিতীয় ভাগের শুরুতেই ক্রোয়েশিয়ার ফরোয়ার্ড মারিও মানজুকিচ কাইল ওয়াকারকে ফাউল করলে ম্যাচের প্রথম হলুদ কার্ড দেখান রেফারি। এর মিনিট পাঁচেক বাদেই ক্রোয়েটদের থ্রোইনে নিজে বল হাতে নিয়ে হলুদ কার্ড দেখেন কাইল ওয়াকার।
তবে এর মাঝে মাঠের খেলাটাও চলতে থাকে সমান প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ৫৬তম মিনিটে হেদসে লিনগার্ডের শট কর্নারের মাধ্যমে ঠেকিয়ে দেন ক্রোয়েশিয়ান ডিফেন্ডার ডোমাগজ ভিদা। পরের মিনিটেই পাল্টা আক্রমণে কর্নার পায় ক্রোয়েশিয়া। তবে দুর্বল কর্নার কিক ক্লিয়ার করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি ইংলিশ ডিফেন্ডার ওয়াকারকে।
কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত দুর্দান্ত খেলা ক্রোয়েশিয়াকে তখনো পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না ইংল্যান্ডের আক্রমণভাগে। বল দখলের লড়াইয়ে তারা এগিয়ে থাকলেও, তাদের খেলা সীমাবদ্ধ মাঝমাঠ বা নিজেদের রক্ষণভাগেই। তবে খেলার ধারার বিপরীতে গিয়ে ৬৪তম মিনিটে দুরপাল্লার এক শটে ইংলিশ রক্ষণ কাঁপিয়ে দেন ইভান পেরেসিচ।
সে যাত্রায় কাইল ওয়াকার জায়গামতো থাকায় গোল না খেয়েই বেঁচে যায় ইংল্যান্ড। তবে ৬৮তম মিনিটে আর পেরেসিচের লম্বা পায়ের ছোঁয়া থেকে বাচতে পারেনি ‘৬৬র বিশ্বকাপজয়ীরা। ডি বক্সের বেশ বাইরে থেকে সিমে ভ্রাসালকোর ক্রসে ইংলিশ ডিফেন্ডার ওয়াকারের মাথার উপর পা তুলে ডান পাশের বার দিয়ে বল জালে জড়ান পেরেসিচ।
গোল দিয়ে যেন নিজেদের ফিরে পায় ক্রোয়েশিয়ানরা। মিনিট তিনেক বাদে আবারো ইংল্যান্ডের রক্ষণে জোরালো আক্রমণ সাজায় তারা। তবে পেরেসিচের বাপ পায়ের শট পোস্টে লেগে ফেরত আসলে হাফ ছেড়ে বাঁচে লুঝনিকিতে উপস্থিত ইংল্যান্ড সমর্থকরা।
৭৪তম মিনিটে রহিম স্টার্লিংকে মাঠ থেকে উঠিয়ে নেন ইংল্যান্ডের কোচ গ্যারেথ সাউথগেট। ক্রোয়েশিয়ানদের একের পর এক আক্রমণে পুরোপুরি কোণঠাসা হয়ে পরে ইংল্যান্ড। তবে ভাগ্য কিংবা নিজেদের ব্যর্থতা; দুই মিলিয়ে গোলের দেখা পাচ্ছিল না ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে তৃতীয় হওয়া ক্রোয়েশিয়া।
৮২তম মিনিটে নিজ দলকে আরো একবার বাঁচিয়ে দেন ইংলিশ গোলরক্ষক জর্ডান পিকফোর্ড। মানজুকিচের কাছ থেকে বল পেয়ে গোল মুখে শট নেন ব্রোজোভিচ। তবে পিকফোর্ডের নিখুঁত পারদর্শীতায় সে যাত্রায় আবারো গোলবঞ্চিত হয় ক্রোয়েশিয়া। ইংলিশ খেলোয়াড়দের শরীরী ভাষাতেই বোঝা যাচ্ছিল ক্রোয়েশিয়ানদের দাপটের কথা।
এরই মাঝে ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণেও আক্রমণের চেষ্টা চালায় ইংল্যান্ড। তবে হেসে লিনগার্ডের ব্যর্থ প্রচেষ্টায় তেমন কোনো সুবিধায় করতে পারেনি ফেবারিটের তকমা গায়ে নিয়ে খেলতে নামা ইংল্যান্ড। ফলে দুই দলের ১-১ সমতায় শেষ হয় নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা।
অতিরিক্ত সময়ের খেলা শুরুর পর শুরু থেকেই চাপ সৃষ্টি করে ইংলান্ড। যার ফলশ্রুতিতে ৯৯ মিনিটে প্রায় গোল দিয়েই বসেছিল তারা। কিন্তু নিশ্চিত এক গোল থেকে ক্রোয়েশিয়াকে রক্ষা করলেন সিমো ভ্রাসালকো।
কেইরান ট্রিপারের ক্রস থেকে ভেসে আসা বলে দারুণ হেড নিয়েছিলেন জন স্টোনস। গোলরক্ষককে ফাঁকি দিয়েছিল বলটি। জালে প্রবেশ করার মুহূর্তে দাঁড়িয়েছিলেন ভ্রাজালকো। একেবারে সঠিক সময়ে সঠিক কম্বিনেশন। অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় হেড করেই সেই বলটি ঠেকিয়ে দিলেন তিনি। নিশ্চিত গোল থেকে তিনি বাঁচিয়ে দিলেন ক্রোয়েশিয়াকে। সে সঙ্গে বেঁচে ক্রোয়েশিয়ার বিশ্বকাপ স্বপ্ন।
পুরো ম্যাচেই পরিসংখ্যানের নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখে ক্রোয়েশিয়া। বল দখলে ইংল্যান্ডের ৪৫ শতাংশের বিপরীতে ক্রোয়েশিয়ার ছিল ৫৫ শতাংশ। গোলমুখে ইংল্যান্ডের ৮টি শটের বিপরীতে তারা নেয় মোট ১৭টি শট।
খবর কৃতজ্ঞতাঃ জাগোনিউজ২৪