১) মেটাবলিক
আমেরিকা ও নরফোকের তিনটি বাঘা বাঘা গবেষণা সম্মেলনে দেখা গেছে, যে প্রত্যেক ঘণ্টা টেলিভিশন-র সামনে (স্ক্রিন টাইম) থাকার দরুণ বয়স, লিঙ্গভেদ, লেখাপড়ার ক্ষমতা, ধূমপান, অ্যালকোহল, ওষুধ ব্যবহার, আনুষঙ্গিক ডায়াবেটিস, পরিবারে আর কারও থাকা না থাকা, ঘুম ও ব্যায়াম ব্যতিরেকে ৬ শতাংশ হার্টের রোগের প্রকোপ (যার মধ্যে হার্টের রোগে মৃত্যুও আছে) বেড়ে যায়।
স্ট্যামাটাকিস ও তার সতীর্থরা, অন্য বড় গবেষণায় আবার দেখান (২০১১) যে দিনে ২ ঘণ্টার বদলে ৪ ঘণ্টা করে টেলিভিশন (স্ক্রিন টাইম) দেখলে, কারণ নির্বিশেষে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পায় ৪৮ শতাংশও হার্টের রোগে মৃত্যু বাড়ে ১২৫ শতাংশ।
অন্যান্য গবেষণা দেখিয়েছে, ব্যায়াম করা ও হেলদি ডায়েট খাওয়ার পরও স্ক্রিন টাইম বাড়ার সঙ্গে রক্তে লিপিড বাড়ে ।
বি. গোপীনাথ, এল. এ. বাউর এবং এল. এল. হার্ডি ওই ২০১৮ সালেই দেখান যে বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে প্রতিঘণ্টা স্ক্রিন টাইম যেমন কিশোর-কিশোরীর রক্তচাপে বাড়িয়ে দেয় দ্রুত, তেমনই প্রতি ঘণ্টা বই পড়লে কমে যায় রক্তচাপ। এমনকী রক্তচাপ অস্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে না। (জার্নাল অব হিউম্যান হাইপারটেনশন)।
২) পুষ্টি
টেলিভিশন দেখতে দেখতে খাবার খেলে, মস্তিষ্কে সেই খাদ্যবস্তুর যে মেমোরি এনকোডিং হওয়ার কথা, সেই এনকোডিং প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। দুঃখের বিষয় টেলিভিশন এক্সপোজার-এর বহু ঘণ্টা বাদে পর্যন্ত দেখা গেছে তার বিষক্রিয়া থাকে। ফলে ছেলে গোঁৎ গোঁৎ করে খেয়ে মোটা হতে পারে বটে, কিন্তু পুষ্টি তার কিছু জোটে না।
এই ছিদ্র দিয়েও কালসাপ ঢুকে শিশুটির রক্তে লিপিডের মাত্রা, সুগারের মাত্রা বাড়িয়ে বসে থাকে।
আর্কাইভ অব পেডিয়াট্রিক অ্যাডোলোসেন্ট মেডিসিন পত্রিকায় ২০০৮-এর গবেষণা দেখায়, যে যদি দু’টি দলে কিশোরদের ভাগ করা যায়, যেখানে গ্রুপ ‘এ’ যত স্ক্রিন টাইম ডোজ পায় গ্রুপ ‘বি’ পায় তার অর্ধেক। তিন বছর বাদে গ্রুপ বি-এর বিএমআই হ্রাস পায় দ্রুতগতিতে যেখানে গ্রুপ ‘এ’-এর বিএমআই থাকে বিপজ্জনক মাত্রায়।
আর আজকের দিনে, আমরা কে না জানি, যে উচ্চ বিএমআই ব্লাড প্রেশার, কোলেস্টেরল ও রক্তে অতিরিক্ত ইনসুলিনের বৃদ্ধি (যা কিনা প্রি-ডায়াবেটিক অবস্থা) ঘটায়!
৩) ব্রেন ও বুদ্ধি
স্ক্রিন টাইম ব্রেনের বারোটা বাজায়। ‘ডোজ-রেসপন্স’ রিলেশনশিপ-এ অর্থাৎ, যত স্ক্রিন টাইম মাত্রা, তত বুদ্ধির বারোটা বেজে তেরোটা! শুধু বুদ্ধিই বা কেন? ২০০৪ সালে ২৬২৩টি শিশুর উপর গবেষণা দেখিয়েছে ১ থেকে ৩ বছরের শিশুরা টেলিভিশন দেখলেই তাদের মনঃসংযোগ ব্যাহত হতে থাকে। প্রতি ঘণ্টা স্ক্রিন টাইম বাড়ায় এডিএইচডি হওয়ার মতো চিত্তবিক্ষেপ ৯ শতাংশ করে।
শিশু বয়সে টেলিভিশন দেখেনি এমন ৫ থেকে ১১ বছরের শিশুদের স্ক্রিন টাইম এক্সপোজার-এ বা ৮ থেকে ২৪ বছরের বয়সিদের স্ক্রিন টাইম দেখার ফলও হয় মারাত্মক।
এ.এস. লিজার্ড ও প্যাটারসন ২০১১ সনে আরো দেখান ৪ বছরের শিশুদের ৯ মিনিটের কার্টুন তাদের একজিকিউটিভ ফাংশন কমিয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ ছেলের আর একজিকিউটিভের চাকরি পাওয়া হলো না, ছোটবেলায় বাবা-মা আদর করে টেলিভিশন দেখাতে দেখাতে খাওয়াতেন বলে।
মস্তিষ্কে ডোপামিনের ক্ষরণ হয় স্ক্রিন টাইম থেকে। অন্যের কষ্ট বোঝার জন্য যে ডরসাল আন্তেরিওর সিংগুলেটেড কর্টেক্স এবং ইনসুলা রিজিওন নামে যে অংশ আছে ব্রেনে, ফাংশানাল এমআরআই করে দেখা গেছে সেখানে কম্পিউটার গেম খেলা বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই জায়গাগুলো নিভে থাকে।
যেসব শিশুর সহমর্মিতা ও সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্র ভালো হয়, এরকম ১০ বছরের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে তাদের মিরর নিউরনগুলোও তত দড় হয়! ২০১১ সালে পার্সোনাল সোশ্যাল সাইকোলজিক্যাল রিভিউ ম্যাগাজিনে গবেষণা প্রকাশিত হয় এই দেখিয়ে যে এই মিরর নিউরোনগুলো চালনা করার জন্য যে মুখোমুখি সামাজিক উদ্দীপনার প্রয়োজন, প্রতি ঘণ্টা স্ক্রিন টাইম সেই মুখোমুখি ভাব আদানপ্রদানের ২৪ মিনিটের সমতুল্য চুরি করে নেয়। কলেজে যখন এই বাচ্চারা যায় বড় হয়ে, তখন তারা আর ভালো করে মিশতে শেখে না। হিংস্রতাও তাদের মধ্যে বেশি দেখা গেছে। আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া জাতীয় রেকমেন্ডেশনের ভিত্তিতে ডাঃ সিগম্যান তাই বলেছেন—
১) যেহেতু ব্রেনের ৮০ শতাংশ বাড়বৃদ্ধি হয় প্রথম ৩ বছর বয়সের মধ্যে, তাই প্রথম ৩ বছরে স্ক্রিন টাইম এক্সপোজার শূন্য করতে হবে। অর্থাৎ এই বয়সের মধ্যে টেলিভিশন ও মোবাইলের সামনে বাচ্চাদের একেবারে আনা যাবে না।
২) ৩ থেকে ৭ বছর বয়সি বাচ্চাদের সাকুল্যে ৩০ থেকে ৬০ মিনিট দৈনিক স্ক্রিন টাইম দেওয়া যেতে পারে।
৭ থেকে ১২ বছর বয়সী বাচ্চাদের জন্যও ধার্য ৬০ মিনিট। ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সি বাচ্চাদের জন্য দেড় ঘণ্টা। ১৬ বছরের পরে ২ ঘণ্টা (সারাজীবন)।
৩) কোনও দিন স্ক্রিন টাইম কম হলেও কোনও ক্ষতি নেই। কিন্তু, কোনওভাবেই কোনও একটি দিনে এই ডোজ-এর এর বেশি হওয়া মানেই কিন্তু ক্ষতি!
ঘুম নেই
স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, ডেস্কটপের অতিরিক্ত ব্যবহার ও অতিরিক্ত টেলিভিশন দেখার ফলে সবচে বেশি দেখা দেয় ঘুমের সমস্যা বা নিদ্রাহীনতা।