২৮ মার্চ দুপুর। চৈত্রের কাঠফাটা রোদ। গাজীপুরের টঙ্গীর বনমালা লেভেল ক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে এক নারী। হাতে বাঁশি। বারবার উঁকি দিচ্ছেন রেললাইনের দিকে। মিনিট পাঁচেক পর দূর থেকে ট্রেনের হুইসেল। দৌড়ে গেলেন সিগন্যালের কাছে। বাঁশি বাজিয়ে দ্রুত রাস্তা খালি করলেন। ফেললেন লোহার প্রতিবন্ধক। কেউ কেউ প্রতিবন্ধক উঠিয়ে রাস্তা পার হতে চাইলেন। কিন্তু তিনি শক্ত হাতে তাঁদের থামান। ট্রেন যাওয়ার পরপরই রাস্তা ছেড়ে দেন।
লেভেল ক্রসিংয়ের দায়িত্ব পালনকারী এই গেটকিপারের নাম মোসাম্মত হালিমা। রোদ-বৃষ্টিতে, কখনো বসে, কখনো দাঁড়িয়ে, সিগন্যাল ফেলার কাজ করেন। শুধু হালিমা নন, গাজীপুরের টঙ্গী রেলস্টেশন থেকে শ্রীপুর স্টেশন পর্যন্ত আছেন অন্তত পাঁচজন নারী। কেউ পরিবারের প্রয়োজনে, কেউবা বেকারত্ব ঘোচাতে এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এর মধ্যে কেউ কেউ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত।
লেভেল ক্রসিংয়ের গেটকিপারের কাজটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সারাক্ষণ চোখ-কান খোলা রাখতে হয়। নিয়মের একটু ব্যত্যয় হলেই ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। বেশির ভাগ লেভেল ক্রসিংয়ে সাধারণত পুরুষ গেটকিপার থাকেন। তাই নারী গেটকিপার দেখে অনেকেই একটু অবাক হন। অনেকে প্রশ্ন করেন, কেন অন্য কাজ করছেন না। আবার কেউ কেউ তির্যক মন্তব্যও করেন।
তবে এসব বিষয়ে হালিমার জবাব সোজাসাপটা। তাঁর কথায়, ‘কাজ সবই সমান। তা ছাড়া আমি এক সপ্তাহ না খেয়ে থাকলেও কেউ একবার জিজ্ঞেস করবে না। তাই মানুষের কথা ভাবি না।’ তিনি বলেন, ‘মেয়ে হয়ে গেটকিপারের কাজ করছি, এটা অনেকেই ভালো চোখে দেখে না। তাই মানুষের সব কথা সহ্য করে চাকরি করছি। সব সময় দায়িত্বটা নিখুঁতভাবে পালনের চেষ্টা করছি।’
শরীয়তপুর জেলার ফাতেমা জাহান। রাজধানীর তেজগাঁও মহিলা কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনার্স পাস করেছেন ২০১৪ সালে। এরপর ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছেন ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্টের ওপর। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখছেন, সরকারি চাকরি করবেন। এ জন্য পড়াশোনা করা অবস্থায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে একাধিকবার চাকরির আবেদন করেছেন। কিন্তু প্রতিবারই বাদ পড়েছেন ভাইভা বোর্ডে। এরপর বাধ্য হয়ে শুরু করেন লেভেল ক্রসিংয়ে গেটকিপারের কাজ।
ফাতেমা জাহান বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন সুকন্দিরবাগ লেভেল ক্রসিংয়ে। এর আগে ছিলেন ভাওয়াল মির্জাপুর লেভেল ক্রসিংয়ে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই চাকরির যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল এসএসসি পাস। কিন্তু আমি মাস্টার্স পাস করে কেন এই চাকরি করতে আসছি আর এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে পারব কি না, তা বারবার জানতে চাওয়া হয়েছিল। আমি কোনো কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেছি। কী করব? টাকা ছাড়া তো চাকরি হয় না। টাকা দিতে পারিনি বলে অন্য চাকরি হয়নি।’
প্রতিটি লেভেল ক্রসিংয়ে গেটকিপার থাকেন তিনজন। প্রত্যেকে ৮ ঘণ্টা করে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে রাতের পালায় দায়িত্ব পড়লে মেয়েরা পড়েন বেকায়দায়। তখন পালা পরিবর্তন করা ছাড়া উপায় থাকে না। মাঝেমধ্যে রাতেও দায়িত্ব পালন করতে হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালক (প্রকৌশল) আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান বলেন, গেটকিপারের কাজগুলো আসলেই বেশি পরিশ্রমের এবং ঝুঁকিপূর্ণ। তারপর সরকারি চাকরিগুলোতে কোটা মেইনটেইন করায় সব কাজই নারীরা করছেন। তাঁরাও এখন গেটকিপারের কাজ করছেন। তবে এতে একেবারে যে অসুবিধা নেই তা–ও না, বিশেষ করে রাতের পালায় ডিউটি পড়লে মেয়েরা একটু সমস্যায় পড়েন। তবে সে ক্ষেত্রে তাঁদের জন্য শিফট পরিবর্তনের একটা সুযোগ থাকে।