মানুষের চিরন্তন আবেগ হলো ভাষা। মানুষের আবেগ-অনুভূতির সার্থক বহিঃপ্রকাশ ঘটে ভাষার মাধ্যমে। ভাষাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অনেক জাতি। তবে ভাষার অধিকার আদায়ে প্রাণ বিসর্জনের অতুলনীয় ইতিহাস কেবল বাংলা ভাষার ভাগ্যেই জুটেছে।
ভাষার মৌখিক রূপের সাধারণত দুটি দিক থাকে। প্রমিত ও আঞ্চলিক। একটি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মুখের কথায় সে ভাষার অনেক আঞ্চলিক রূপ পরিলক্ষিত হয়। অঞ্চলভেদে এ রূপগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়। প্রতিটি অঞ্চলের ভূপ্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে কালক্রমে গড়ে ওঠে সেখানকার আঞ্চলিক ভাষা। তাই একই দেশের মধ্যে এক অঞ্চলের ভাষার সঙ্গে অন্য অঞ্চলের ভাষার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
শুদ্ধ ভাষা চর্চা, আঞ্চলিক ভাষার প্রতি তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিভঙ্গি সব মিলিয়েই আঞ্চলিক ভাষার স্বকীয়তা আড়ালে চলে গেছে। তবে রাজশাহীরও একটি ঐতিহ্যবাহী আঞ্চলিক ভাষা রয়েছে। ভাষাবিদদের নিকট রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষা মূলত পরিচিত ‘বরেন্দ্রী’ উপভাষা হিসেবে। পদ্মা ও মহানন্দার তীর জুড়ে বসবাসকারী মানুষদের মুখের ভাষাই পরিচিত বরেন্দ্রী উপভাষা। রাজশাহী ছাড়াও মালদহ, নওগাঁ, দিনাজপুর অঞ্চলে এই উপভাষার প্রচলন রয়েছে।
রাজশাহীর স্থানীয় ভাষা নিয়ে মজার ছলে প্রায়ই একটি বাক্য বলার প্রচলন আছে, ‘মামুর বুঠা। বুললেই তো বুলবেহেনি যে বুইলছে।’ আবার বিভিন্ন নাটকে রাজশাহীর স্থানীয় ভাষার আলোচিত বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। রাজশাহীতে কালাই রুটির দোকানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘হারঘেঁ কালাই’, যা মূলত চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে ‘আমাদের কালাই’–এর স্থানীয় রূপ।

আবার, রাজশাহী শহরের ভাষার সাথে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভাষার কিছুটা মিল থাকলেও রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলার ভাষাতে বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন পুঠিয়া বা দুর্গাপুর উপজেলার ভাষার সাথে চারঘাট কিংবা বাঘা উপজেলার ভাষাগত পার্থক্য সুস্পষ্ট। তবে রাজশাহী অঞ্চলের ভাষা বলতে রাজশাহী শহরের ভাষাকেই বোঝানো হয়।
রাজশাহী অঞ্চলের ভাষা মোটামুটি সমগ্র বঙ্গেই বেশ জনপ্রিয়। এ অঞ্চলের মানুষ কথা বলার সময় এক ধরনের সুর দিয়ে কথা বলে। সুর দিয়ে কথা বলাও ভাষার অংশ। ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরা গানে এই উপভাষা ব্যবহৃত হয়।
গবেষণামূলক বিভিন্ন লেখা থেকে জানা যায়, রাজশাহী শহরের স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষায় ‘স’–এর জায়গাটি দখল করে নিয়েছে ‘শ’ আর ৫০ কিলোমিটার দূরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্থানীয় ভাষায় ‘ছ’–এর প্রভাব খুব বেশি। সেখানে শ-ষ-স–এর জায়গা দখল করে নিয়েছে ‘ছ’। আবার ‘আ’–এর জায়গা নিয়েছে ‘হ’। রাজশাহীতে বাসকে উচ্চারণ করা হয় ‘বাশ’, সিনেমাকে ‘শিনেমা’, সিদ্দিককে ‘শিদ্দিক’, স্যারকে ‘শার’।
রাজশাহীর জনপ্রিয় কথার কয়েকটি-
* কঠ্ঠিন ব্যাপার মামুর বটা;
* ম্যালা গরম পইড়ছে;
* পার্ট লিছো ক্যান/ ফাঁপড় লিছো ক্যান?
* চিল্যাছিস ক্যান বে?
* ল্যাও ঠ্যালা!
* খিদির-বিদির কইরছো ক্যান?
* প্যাছতেই পাইরছোনা!
* ওক গিরিপে লে / ঘিরে লে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনেও রাজশাহীর জনগণের সাহসী ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে আছে।
রাজশাহীর ভাষায় অ্যানিমেশন তৈরি করার জন্য ২০১১ সালে ইয়াসিন রেজা ও ফয়জুল মতিন নামে দুজন রাজশাহী নগরের অলোকার মোড়ে ‘স্টিমিং ব্রেইন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। প্রায় এক বছর ধরে কার্যক্রম চলাকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠানটি ১৫০টি কার্টুন তৈরি করে। সেখানে হাবা ও গোবা নামের দুটি চরিত্রের মুখে রাজশাহীর ভাষা কথা বলানো হতো। তবে বর্তমানে বন্ধ আছে।
পাঠক, আঞ্চলিক ভাষাকে হেয় করার বা দেখার একটা প্রবণতা রয়েছে অনেকেরই। এই প্রবণতা বা মানসিকতা আমাদের দূর করতে হবে। কারণ প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব ভাষা বৈশিষ্ট্য আছে, সেটা থাকবেই। পৃথিবীর সব দেশের, সব অঞ্চলের ভাষাতেই আঞ্চলিক টান থাকে। এটা মানুষের সহজাত ব্যাপার। আঞ্চলিক ভাষা হীনম্মন্যতার বিষয় নয়; বরং গৌরবের ব্যাপার। প্রত্যেকের নিজ নিজ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে কোনো লজ্জা নেই। প্রকৃত প্রস্তাবে আঞ্চলিক ভাষাই সে অঞ্চলের মানুষের মাতৃভাষা।
হোক আঞ্চলিক ভাষা কিংবা প্রমিত বাংলা ভাষা , মাতৃভাষার আলোচনায় রাজশাহীর অবস্থান অবিচ্ছেদ্য ও অনন্য।