আশি ও নব্বই দশকে বিনোদনের প্রধানতম মাধ্যম ছিল রেডিও। তখন রেডিও মানেই চলচ্চিত্রের গান, আর চলচ্চিত্রের গান মানেই যেন ছিল এন্ড্রু কিশোরসহ তৎকালীন জনপ্রিয় শিল্পীদের গান। এন্ড্রু কিশোর বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বাধিক ১৫ হাজার গান গাওয়া শিল্পী। চলচ্চিত্রে তাঁর চেয়ে বেশি জনপ্রিয় গান সম্ভবত আর কারও নেই।
জন্ম, পড়াশোনা ও সংগীত জগতে প্রবেশ:
বাংলা গানের কিংবদন্তী ও ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ এন্ড্রু কিশোরের জন্ম ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহীতে। তাঁর পিতা ক্ষীতিশ চন্দ্র বাড়ৈ এবং মাতা মিনু বাড়ৈ রাজশাহীর একটি হাসপাতালে চাকরি করতেন। এন্ড্রু কিশোরের মাতা মিনু বাড়ৈ ছিলেন সংগীত অনুরাগী যিনি কিশোর কুমারের গান পছন্দ করতেন, সেই সুবাদেই নিজের সন্তানের নাম রাখেন কিশোর। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে গানের জগতে পা রাখেন এন্ড্রু কিশোর আর তাই গত শতকের ৭০-এর দশকে গানের নেশায় রাজশাহী থেকে ঢাকায় পাড়ি জমান তিনি। এন্ড্রু কিশোরকে ঢাকামুখী করার ও জাতীয় পর্যায়ে পা রাখতে যারা ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে রাজশাহীর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পুরোধা, বীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন প্রামাণিক অন্যতম।
রাজশাহীতেই প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ শেষ করে অধ্যয়ন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগে। তিনি নজরুল সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত, আধুনিক, লোকসংগীত ও দেশত্মবোধক গান দিয়ে রাজশাহী বেতারে তাঁর গায়কী জীবন শুরু করেন। বেতারে গান গাওয়ার আগে তিনি প্রাথমিক ভাবে আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে সঙ্গীত পাঠ শেষ করেন। পরবর্তীতে ‘সুরবাণী’ নামে একটি সংগীত বিদ্যালয়ে আধুনিক বাংলা, রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, লোকগীতি গানের তালিম নেন তিনি। এন্ড্রু কিশোরের গানের শিক্ষক ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু ছিলেন রাজশাহীর সংগীতাঙ্গনের এক মহীরূহ। শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে তিনি জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিলেন।
জাতীয় নানা আন্দোলন সংগ্রামে এন্ড্রু কিশোর:
বীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন প্রামাণিক গণমাধ্যমকে জানান, “৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র আন্দোলন ও ৬২’র শিক্ষা আন্দোলনে রাজশাহীর সংগীত শিল্পীরা বরাবরই ভূমিকা রেখেছেন। বিশেষ করে ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের সময় এন্ড্রু কিশোর ও তার সমসাময়িক শিল্পীদের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা পাঁচ-ছয়টি ট্রাকে চড়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে গণসংগীত গাইতেন। অনেক সময় দেখেছি গণসংগীতে ছেলাবেলাতেই এন্ড্রু কিশোর নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং অন্যরা যারা তার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন তারাও তার কণ্ঠে সুর মিলিয়েছেন। রাজশাহীতে জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাস এন্ড্রু কিশোরকে বাদ দিয়ে হবে না।’
এন্ড্রু কিশোর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবারের সঙ্গে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে শরণার্থী শিবিরগুলোতে ঘুরে ঘুরে গান গেয়েছেন, গানে গানে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছেন।
জীবিকার তাগিদে মনোহারী দোকান:
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে এক কাণ্ড করেছিলেন এন্ড্রু কিশোর। শহরের মনিচত্বরে জেলা পরিষদের মার্কেটে মনোহারী দোকান খুলে বসেছিলেন!
বীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন প্রামাণিকের ভাষ্যমতে, ‘তখন সময়টা ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলের শেষের দিকে। তৎকালীন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের আন্দোলন চলছিল। ছাত্ররা অনশন করছিল। সে সময় আমি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মোজাফফর) রাজশাহী জেলা কমিটির সভাপতি ছিলাম। আমি সেখানে ছাত্রদের অনশন ভাঙানোর জন্য যেতে চাইছিলাম। তখন আমাদের সহকর্মী অ্যাডভোকেট অসিত সেন বললেন- “আপনি তো বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন, ছাত্রদের জন্য গ্লুকোজ নিয়ে যান। চলেন এন্ড্রু কিশোরের দোকান থেকে গ্লুকোজ কিনে আনি”। আমি এ কথা শুনেই অবাক। বলে কী! এন্ড্রু কিশোর কোথায় দোকান দিয়েছে? কিসের দোকান?’
শুনলাম, শহরের মনিচত্বরে জেলা পরিষদের মার্কেটে এন্ড্রু কিশোর একটি দোকান দিয়েছে। আমি সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখি সত্যি সে মনোহারী দোকান খুলে বসে আছে। প্রসাধনী সামগ্রীর পাশাপাশি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যও ছিল। সেদিন ওর দোকান থেকে আমি ছয় প্যাকেট গ্লুকোজ কিনেছিলাম। তাকে বললাম, “তুমি এখানে কী করো?” সে বলল, “কিছু তো করতে হবে, তাই এই দোকান দিয়েছি”। বললাম, “তুমি এই দোকান আজই বন্ধ করো”। সে বলে, “দোকান বন্ধ করে করব কি?” বললাম, “তুমি ঢাকায় যাও।” সে বলল, “ঢাকায় গিয়ে কী করব?” বললাম, “ঢাকায় গিয়ে রাস্তায় শুয়ে থাকবা। তোমার দোকান করা যাবে না।” তখন এন্ড্রু কিশোরের বাল্যবন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন ছবি ঢাকায় থাকে। আমি এন্ড্রু কিশোরকে বললাম, “তুমি ছবির কাছে যাও, গিয়ে তার সঙ্গে দরকার হলে তার ঘরের মেঝেতে থাক, আর গান গাওয়ার চেষ্টা করো। যাও, তাড়াতাড়ি চলে যাও।” এভাবে উদ্বুদ্ধ করার পর কিশোর আমার কথা রেখেছিল। সে ঢাকায় গিয়ে ছবির বাসাতেই উঠেছিল। ঢাকায় সংগীত পরিচালকদের নজর কাড়তে তার এক বছরও লাগেনি। তারপরের কথা তো সবাই জানে। কিশোর জাতীয় ঐশ্বর্যে পরিণত হয়েছে।’
প্রথম গানের পারিশ্রমিক মাত্র ৮০০ টাকা:
জীবনের প্রথম গান গেয়ে মাত্র ৮০০ টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। সেকথা এক সাক্ষাৎকারে নিজেই বলেছিলেন শিল্পী। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রথম কোনো গান করলাম পেশা হিসেবে। সে গানের জন্য পারিশ্রমিক ৮০০ টাকা দেবে ঠিক হলো। তখন আমি রাজশাহী থাকি। টাকাটা ছিল ঢাকায়। এসময় খবর পেলাম স্কুলের এক বড় ভাই ঢাকা থেকে আসছেন। যারা টাকাটা দেবে তাদের বলে দিলাম, আমার টাকাটা ভাইয়ের কাছে দিয়ে দিন। সেই ভাই তার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে সব টাকা শেষ করে ফেললো।’
চলচ্চিত্র জগতে যাত্রা:
১৯৭৭ সালে “মেইল ট্রেন” চলচ্চিত্রে আলম খানের সুর ও সংগীত পরিচালনায় “অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ” গানে কণ্ঠ দিয়ে এন্ডু কিশোর তাঁর চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার শুরু করেন। তবে তিনি গায়ক এন্ডু কিশোর হিসেবে সাড়া ফেলেন ১৯৭৯ সালে মনিরুজ্জামান মনিরের লেখা ও আলম খানের সুর ও সংগীতে গাওয়া “ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে” গানের মাধ্যমে।
১৯৭৯ সালে প্রতিজ্ঞা চলচ্চিত্রের ‘এক চোর যায় চলে’ গান গাওয়ার পর আর পেছনে ফিরতে হয়নি তাকে। একের পর এক জনপ্রিয় গান উপহার দিতে থাকেন। এন্ড্রু কিশোর ভারতের প্রখ্যাত সুরকার আর ডি বর্মণের সুরেও গান গেয়েছেন, সেই সাথে বাংলাদেশের সকল জনপ্রিয় সুরকারদের সাথে গান গেয়েছেন। তাঁর প্রতিটা গান মানুষের হৃদয় ছুয়ে যায় যে গানে আছে হাসি-আনন্দ প্রেম-বিরহ সহ সুখ দুঃখের অনুভূতি।
জনপ্রিয় কয়েকটি গান:
হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস, ভালবেসে গেলাম শুধু, আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, ডাক দিয়েছেন দয়াল আমারে, সবাই তো ভালবাসা চায়, জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প, সবাই তো ভালবাসা চায়, আমার বুকের মধ্যে খানে, আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান, ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা, আমি চিরকাল প্রেমেরও কাঙাল, বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে- এমন অসংখ্য গান এখনও মানুষের মুখে ফেরে। গান গেয়ে আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন এন্ড্রু কিশোর।
এন্ড্রু কিশোরকে নিয়ে স্মৃতিচারণ:
এন্ড্রু কিশোরকে নিয়ে অনেক স্মৃতি একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা কণ্ঠশিল্পী লীনু বিল্লাহর। দেশের প্রথম দিককার ব্যান্ড ‘জিঙ্গেল’র সদস্য মঞ্জুরুল আলম বিল্লাহ লীনু, যিনি লীনু বিল্লাহ নামেই সঙ্গীত জগতে পরিচিত। গণমাধ্যমে তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, “বিখ্যাত শিল্পী রাহুল দেব বর্মন ওর গান শুনে বলছিল- এন্ড্রু তুই চলে আয়, বোম্বে (এখন মুম্বাই) চলে আয়, এখানে এলে চিন্তাও করতে পারবি না। ও (এন্ড্রু) বলেছিল, আমি যাব না। এন্ড্রুর ক্যাটাগরির শিল্পী কিন্তু বোম্বেতে নেই, বাংলাদেশে তো নেই-ই। যদি রাহুল দেব বর্মণের সঙ্গে ওই ব্যাপারে সম্পৃক্ত হতে পারত, তাহলে ইন্ডিয়া- বাংলাদেশের মধ্যে এক নম্বর শিল্পী থাকত এন্ড্রু। মানে কিশোর কুমার মারা যাওয়ার পরে।”
ব্যবসায়ী এন্ড্রু কিশোর:
মাঝে কিছুদিন ব্যবসাও করেছিলেন এন্ড্রু কিশোর। ১৯৮৭ সালে আহমাদ ইউসুফ, আনোয়ার হোসেন বুলু, ডলি জহুর প্রমুখের সঙ্গে টিভি নাটক, বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য প্রযোজনার জন্য ‘প্রবাহ’ নামে একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান শুরু করেন।
জীবনের বেশির ভাগ সময়ে মূলত চলচ্চিত্রে গান করেই কাটিয়েছেন এন্ড্রু কিশোর। চলচ্চিত্রে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে অডিও বাজারে খুব একটা অ্যালবাম করেননি। চলচ্চিত্রের বাইরে এসে প্রথম দিকে তিনি ‘ইত্যাদি’তে গান করেন ‘পদ্মপাতার পানি নয়’, যা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তীকালে বেশ কয়েকবার ‘ইত্যাদি’তে সংগীত পরিবেশন করেছেন।
এন্ড্রু কিশোর লিপিকা অ্যান্ড্রু ইতির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দুটি সন্তান রয়েছে। কন্যা মিনিম অ্যান্ড্রু সংজ্ঞা এবং পুত্র জয় অ্যান্ড্রু সপ্তক।
এন্ড্রু কিশোরের জীবনের শেষ গল্প:
এন্ড্রু কিশোর ২০২০ সালের ৬ জুলাই ৬৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। নন-হজকিন লিম্ফোমা নামক ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন তিনি সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেছিলেন। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করেও ক্যান্সার নির্মূল হয়নি প্রখ্যাত এই সংগীতশিল্পীর। চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি নিজের ইচ্ছায় দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি আমার দেশে গিয়ে মরতে চাই, এখানে নয়।’ একই বছর ১১ জুন বিকেলে সিঙ্গাপুর থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে ফেরেন তিনি। ফিরে যান রাজশাহীতে, যেখান থেকে তাঁর শুরু। নিজের শহর রাজশাহীর মহিষবাথান এলাকায় বোনের বাড়িতে শেষ হয় তাঁর জীবনের গল্প।
পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশকে রাজশাহীর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সমৃদ্ধির যে দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছিল সেই আলোতেই বেড়ে ওঠেন জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী এন্ড্রু কিশোর। তারপর দেশ, বিদেশে অর্জন করেন তুমুল খ্যাতি। এখনকার বাস্তবতায় তাঁর মতো জাতীয় সম্পদে পরিণত হতে পারে এমন গুণী শিল্পী আবার কবে জন্ম নিবেন তা বলা কঠিন। জন্ম শহর, দেশ এবং দেশের বাইরে এন্ড্রু কিশোর বেঁচে আছেন ভক্তদের স্মরণে, তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মের মাধ্যমে।