“কর্মশালার প্রবেশের দ্বার অতি ক্ষুদ্র রাজপ্রাসাদের সিংহদ্বারের ন্যায় ইহা অভ্রভেদী নহে/কিন্তু গৌরবের বিষয় এই যে/এখনে নিজের শক্তি সম্বল করিয়া প্রবেশ করিতে হয়। ভিক্ষাপাত্র লইয়া নহে।” কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই লেখনী অন্তত শিক্ষানগরী রাজশাহীর তরুণ-তরুণী উপেক্ষা করতে পারেন। কেননা যথাযথ যোগ্যতা, দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই শুধুমাত্র রাজশাহীতে অবস্থানের জন্য কর্মে যুক্ত হতে পারেন না। নির্মম হলেও সত্য আজকের আধুনিক রাজশাহীর প্রধান সমস্যা কর্মসংস্থানের অভাব।
পরিচ্ছন্ন, সবুজ শহর হিসেবে রাজশাহীর খ্যাতি থাকলেও এখানে কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। শিক্ষানগরী খ্যাত রাজশাহীতে নেই তেমন কোনো শিল্পকারখানা। ফলে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে কর্মসংস্থানের জন্য ঢাকাসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহরে পাড়ি দিতে হয় অধিকাংশ তরুণ-যুবাদের। শিক্ষানগরী রাজশাহীতে শুধু মানসম্মত শিক্ষাই মেলে, কর্মসংস্থান নয়। রাজশাহীর শিক্ষিত তরুণেরা যদি রাজশাহীতে থেকেই কিছু করতে পারেন- তাহলে একদিকে যেমন ঢাকা নির্ভরতা কমবে, অন্যদিকে রাজশাহীকেও তারা সমৃদ্ধ করতে পারবেন নানাভাবে।
দিনদিন বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। উচ্চশিক্ষিতরা বেকার হওয়ার কারণে সমাজে এক ধরনের অস্থিরতাও বিরাজ করছে। অর্থনৈতিক মন্দাসহ নানা কারণে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। নতুন করে চাকরি হারাচ্ছেন অনেকেই। পড়াশোনা করার পরও শিক্ষিত যুবকদের কর্ম না থাকায় তাদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে।
বাস্তবতা হলো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। যা বছরের পর বছর আন্তরিক ও সামষ্টিক প্রচেষ্টার ফল।
অতীতঃ
ষাটের দশকে রাজশাহীতে সরকারিভাবে চিনিকল, পাটকল, টেক্সটাইল এবং রেশমের মতো যে বড় চারটি শিল্প কারখানা স্থাপন করা হয়েছিলো- অবহেলা, লোকসানে সেগুলো এখন স্থবির! পরবর্তী সময়ে ভারি কোন শিল্পকারখানা এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
কেন কর্মসংস্থান গড়ে উঠছে না?
প্রথমত, নির্মম হলেও সত্য নতুন কর্মসংস্থানের জন্য যেরকম আর্থসামাজিক পরিবেশ দরকার, সেরকম পরিবেশের ঘাটতি রয়েছে রাজশাহীতে। সড়কপথই যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। ট্রেন চালু থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বিমানে যাত্রী পরিবহন করা গেলেও পণ্য পরিবহনের সুযোগ নেই, পণ্যবাহী কার্গো বিমান এখনো চালু হয়নি। সড়কপথে রাজধানী ঢাকায় যেতে সময় লাগে প্রায় সাত থেকে আট ঘণ্টা। রাজশাহীর নিকটবর্তী সোনা মসজিদ স্থলবন্দরের অবকাঠামো বেশ দুর্বল। দেশের অন্যতম প্রধান নদী-পদ্মা নদী রাজশাহীতে থাকলেও এখানে নেই কোনো নদীবন্দর।
দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগের জন্য এখাননে রয়েছে নানান প্রতিবন্ধকতা। গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় উদ্যোক্তারা এ অঞ্চলে শিল্পকারখানা স্থাপনে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ২০১৩ সালে রাজশাহী নগরীতে গ্যাস সংযোগ চালু হওয়ার পর অনেকেই শিল্প স্থাপনের জন্য জমি কিনেছিলেন। কিন্তু এই খাতে গ্যাস সংযোগ শিল্প-কারখানায় দেয়া হচ্ছে না।
তৃতীয়ত, প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে অনিয়ম এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রাজশাহীতে কর্মসংস্থান গড়ে না ওঠার অন্যতম কারণ।
কী করা যেতে পারে?
কর্মসংস্থানের জন্য বড় আকারে শিল্পায়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের কোন বিকল্প নেই। এখানে আমসহ কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলা হলে একদিকে স্থানীয় কৃষকেরা যেমন লাভবান হবেন, তেমনি এই অঞ্চলে কর্মসংস্থানেরও প্রসার ঘটবে। পদ্মা নদীতে ড্রেজিং করে নৌ-পরিবহন, নদীবন্দর চালু করা যেতে পারে। কার্গো বিমান, কৃষিপণ্য সরবরাহে রাজশাহী থেকে ঢাকা পর্যন্ত বিশেষ ট্রেন চলু(ম্যাঙ্গো স্পেশাল ট্রেনের মতো), সোনা মসজিদ স্থলবন্দর আধুনিকায়ন, দ্রুততম সময়ে শিল্প কলকারখানায় গ্যাস সংযোগ প্রদানসহ রাজশাহীর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সুসমন্বয় প্রতিষ্ঠা করা গেলে রাজশাহীর অর্থনীতি যেমন চাঙা হবে, তেমনি বাড়বে কর্মসংস্থান।
বর্তমান পরিস্থিতিঃ
বরেন্দ্র অঞ্চল বিশেষত রাজশাহী বিনিয়োগের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বড় কারখানা স্থাপনে এগিয়ে এসেছে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা। ফলে ধীরে ধীরে গতি পাচ্ছে এ অঞ্চলের অর্থনীতি।
রাজশাহীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্কে প্রায় ১৪ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই পার্কে দু’টি অংশ রয়েছে- শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন বিল্ডিং ও সজীব ওয়াজেদ জয় সিলিকন টাওয়ার।
এলাকাভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিতের মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রায় ৩৩৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা নদীর তীরে রাজশাহী মহানগর সংলগ্ন এলাকায় প্রায় ৩১ একর জমির ওপর পার্কটি নির্মাণ করা হয়েছে।৬২ হাজার বর্গফুটের আইটি ইনকিউবেশন সেন্টারে একটি অত্যাধুনিক অফিস ভবনসহ বহুমুখী প্রশিক্ষণ সুবিধা, উচ্চ-মানের স্টার্ট আপ, বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের ব্যবস্থা রয়েছে। সামগ্রিকভাবে পার্কটি দেশি- বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার মাধ্যমে ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টির পাশাপাশি রাজশাহীতে একটি জ্ঞানভিত্তিক আইটি শিল্প প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি নতুন তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে এটি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
রাজশাহীতে এরই মধ্যে ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার বেশ কয়েকটি বড় কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে। ভারতীয় টাটা গ্রুপ দেশিয় নিলয় গ্রুপর সঙ্গে যৌথভাবে চালু করেছে মোটরযান তৈরির কারখানা। এছাড়া কোরিয়াভিত্তিক আরো কয়েকটি কোম্পানির বিনিয়োগ প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়েছে।
সর্বশেষ রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে স্লোগান দেয়া হয়েছিলো ‘উন্নয়ন দৃশ্যমান, এবার হবে কর্মসংস্থান’। আধুনিক রাজশাহীর রূপকার এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের নির্বাচনী ইশতেহারেও ছিলো কর্মসংস্থান প্রসঙ্গ।
কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে রাজশাহী এলাকার তরুণদের বেকারত্ব হ্রাস, সর্বোপরি রাজশাহীর বহুমাত্রিক উন্নয়ন এই সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। রাজশাহীবাসী আশা ও বিশ্বাস করেন, এবার গ্রিন-ক্লিন-শিক্ষা নগরীর পাশাপাশি পর্যটন শহরের তকমা লেগে যাওয়া রাজশাহীতে গড়ে উঠবে শিল্পায়ন, গার্মেন্টস, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, অর্থনৈতিক জোন, আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকাসহ নৌবন্দর।