বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে সব থেকে সুন্দর, পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন শহর রাজশাহী। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি সারা বছর সবুজ সমারোহে ছেয়ে থাকে শহরের পথঘাট। রাস্তার মাঝ বরাবর সারিসারি লাগানো হয়েছে নানা প্রজাতির অসংখ্য গাছপালা। রাতের বেলা নান্দনিক নকশায় ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আলোকিত হয়ে থাকে চারিদিক। এক দেখাতে মুগ্ধ হবেন যে কেউ!
শহরের একপাশ দিয়ে বয়ে গেছে বাংলাদেশের অন্যতম বড় ও প্রমত্ত নদী পদ্মা। পদ্মার পাড়ে পর্যটকদের জন্য গড়ে উঠেছে বেশ কিছু পার্ক, রিসোর্ট, টি-বাঁধ, আই-বাঁধ, পদ্মা-গার্ডেন, মুক্ত মঞ্চসহ আরো অনেক দর্শনীয় স্থান। প্রতিদিন এসব জায়গায় ঘুরতে আসেন হাজারো পর্যটক। বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে পদ্মার পাড়।
এই সুন্দর শহরকে দৃষ্টিনন্দন করতে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। গত ২৯শে জানুয়ারি সফরে এসেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় রাজশাহী শহরকে ঘিরে মোট ২৬টি প্রকল্পের ফলক উন্মোচন করেন তিনি। ভিত্তিপ্রস্থর উন্মোচন করা হয়েছে আরও ৬টি প্রকল্পের। প্রকল্পগুলোর আওতায় নগরীর সিএন্ডবি ক্রসিং এ নির্মিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ও শেখ রাসেল শিশু পার্ক।
রাজশাহী চিড়িয়াখানার সামনে ২০১৮ সালের ২২শে অক্টোবর থেকে ২৩২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার। এর উদ্ধোধন হতে পারে এই বছরের জুন মাসে।
পদ্মার পাড়ে তীর ঘেঁষে আই-বাঁধের পাশে ৩৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্ক। গত ডিসেম্বর মাসে এটির উদ্ধোধন করা হয়। এখানে প্রায় ১৪ হাজার মানুষের কর্মস্থান হবে বলে মনে করছে সরকার। বেকারত্ব দূরীকরণ ও জনগণকে আইটিতে দক্ষ করার লক্ষ্যে সরকার দেশে এরকম হাই-টেক পার্ক গড়ে তুলছে। বর্তমানে এই হাইটেক পার্কে বিজনেস অটোমোশন, ওমেন এ্যান্ড ই-কমার্স, রিয়েল আইটি, এমডি ইনফোটেকসহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া স্টার সিনেপ্লেক্সের একটা শাখা তৈরি করা হয়েছে এখানে, যেখানে প্রতিদিন সিনেমাপ্রেমীরা সিনেমা দেখতে আসেন।
নগরীর উন্নয়নে নির্মিত হচ্ছে বেশ কিছু রাস্তা, ফ্লাইওভার ও ৪ লেনের সড়ক, নর্দমা এবং ফুটপাত। উদ্বোধন হওয়া ২৬টি প্রকল্পের মধ্যে ব্যয় প্রায় ১ হাজার ৩ শ ১৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এছাড়া ৩৭৬ কোটি ২৮ হাজার টাকা ব্যয়ে ৬টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রতিটি স্থাপনা স্থাপিত হচ্ছে সুপরিকল্পিতভাবে। এক কথায় পাল্টে যেতে চলেছে রাজশাহীর চেহারা।
উন্নত বিশ্বের যেকোনো পরিপাটি শহরের মত হবে রাজশাহী। গত ১৪ বছরের উন্নয়ন প্রকল্পে ১০ হাজার ৬শ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ইতোমধ্যে সকলের প্রচেষ্টায় সেজে উঠেছে নগরী। আগের তুলনায় গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলো আরো প্রসস্ত হয়েছে। রাস্তার মাঝখানে থাকা বিভাজকে চেরি, রঙ্গন, কাঠগোলাপ, করবী ও অলকানন্দা ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে। রাস্তার দু’পাশে লাগানো হয়েছে কৃষ্ণচূড়াসহ অন্যান্য গাছ, যা রাস্তার সৌন্দর্যকে আরো বেশি বৃদ্ধি করেছে। পাশাপাশি আশেপাশের বাতাসকে নির্মল করে তুলেছে গাছগুলো।
প্রতিদিন রাতে পরিষ্কারকর্মীরা রাস্তা ঝাড়ু দিতে আসেন। প্রতিটি দোকানে সিটি কর্পোরেশন থেকে দেওয়া হয়েছে ময়লার ঝুড়ি। বাসাবাড়ির ময়লা আবর্জনাও নিয়ম মেনে সংগ্রহ করা হয়। ফলে রাজশাহীতে যেখানে সেখানে ময়লার স্তূপ দেখতে পাওয়া যায় না। তারপরও যদি কোথাও কোনো জায়গায় ময়লার স্তূপ দেখা যায় তা দ্রুত সরিয়ে ফেলা হয়। সঙ্গত কারণেই এই নগরীর বাতাসে দুষিত পদার্থ ও রোগ জীবাণুর পরিমাণ খুব কম।
পাশাপাশি শহরের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে দেয়ালে ব্যানার, ফেস্টুন লাগানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফুটপাতে বিকাল ৪টার আগে কোনো প্রকার অস্থায়ী ব্যান্ড, দোকান, ফেরিওয়ালার বসার অনুমতি নেই। শুধুমাত্র ঘোষণা করে থেমে থাকেনি সিটিকর্পোরেশন, দিন-রাত কড়া নজরদারিতে রাখা হয়। সব মিলিয়ে রাজশাহীর পরিবেশ দিন দিন আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে। নগরীর বাসিন্দারাও শহরটি নিয়ে গর্ববোধ করেন। অনেকের মতে বাংলাদেশের সব চাইতে বাসযোগ্য শহর এটি।
পুরাতন বাসিন্দারা জানান, আগের রাজশাহী ও বর্তমান রাজশাহীর মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। সুপরিকল্পিত নগরায়ন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণে এত সুন্দর হয়ে উঠেছে আজকের রাজশাহী। বর্তমানে সিটি কর্পোরেশনের এমন উদ্যোগ দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন শহরবাসিও, কেউ আর যত্রতত্র ময়লা ফেলেন না। পর্যটন স্থানগুলো কেউ নোংরা করে রাখেন না, অধিকাংশ নাগরিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিধান মেনে চলেন। বর্তমানে উত্তর বঙ্গের সব থেকে বড় শহর রাজশাহী “গ্রিন সিটি” নামে পরিচিতি পেয়েছে। অন্যতম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কোও।
রাজশাহী শহর শিক্ষা নগরী হিসেবেও পরিচিত। এখানে রয়েছে দেশ সেরা রাজশাহী কলেজ। বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার এই কলেজের মুসলিম হোস্টেলের এফ ব্লকের সামনে অবস্থিত। এছাড়া রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বারিন্দ মেডিকেল কলেজ, ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ সহ আরো অনেক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য মন কাড়ে সকলের।
পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা এক স্বপ্নের শহর রাজশাহী। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, বাংলাদেশের প্রত্যেকটি শহরের জন্য রাজশাহী হতে পারে রোল মডেল!